২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফেরে না সব পাখি

-

সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলে যায়। দশ বছর আগে কে বলতে পারত, এই অজপাড়াগাঁয়ে একদিন শহরের উৎকট ধোঁয়া এসে লাগবে। আজ পাকা সড়ক হয়েছে, পুরো গ্রামে বিদ্যুৎ না পৌঁছালেও যে কয় পাড়ায় বিদ্যুৎ আছে তাতেই যেন আলোকিত সারা গ্রাম। রোজ সন্ধ্যাায় তিন মাথা মোড়ে রমিজের চায়ের দোকানে জড়ো হয় খেটে খাওয়া মানুষগুলো। ডিশ লাইনের কল্যাণে প্রাপ্ত দেশ-বিদেশের নানা খবর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে মাঝরাত অবধি। চা পানের ফাঁকে সেদিন মেলা নিয়ে কথা হচ্ছিল। এবার মেলায় লাঠিখেলা থাকবে না শুনে বেজায় ক্ষেপে যায় কাসু মেম্বার। নাম কাসু মেম্বার হলেও আদতে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নন। ছিলেনও না কোনো কালে। তবে লোকমুখে শোনা যায় বয়সকালে তিনি নাকি তিন তিনবার নির্বাচন করেছিলেন। ভাগ্য খারাপ! টাকা-পয়সা সাধ্যমতো খরচ করেও জিততে পারননি কোনোবার। জোত-জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে গিয়ে নিঃস্বপ্রায় অবস্থা। তার পরই লকব জুটে যায় মেম্বার। অবশেষে স্থির হলো লাঠি খেলা চলবে; শহর থেকে যে বায়োস্কোপ পার্টি আসার কথা ছিল তাই বরং বাতিল করা হবে। কাসু মেম্বারের কথায় জলিল মাস্টার সায় দেয়াতে কাজ হয়েছে দ্রুত।
এবারই প্রথম রতন ভাইয়ের সাথে মেলায় এসেছে মিনা। ওদের সাথে মিনার ছোট বোন মিতুও আসার জন্য বায়না ধরেছিল। কিন্তু কেন যেন মিনার মা মিতুকে তাদের সাথে আসতে দিলেন না। রতন মিনার মামাতো ভাই। মিনাদের গ্রামের দুই গ্রাম পরেই রতনদের বাড়ি। রতন সাভারের একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। নববর্ষের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। রতনের সাথে আসতে অবশ্য মিনারই অনেক সঙ্কোচ বোধ হয়েছে। মিনার সাথে রতনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। রোজার ঈদের পরে রতনের ছোট কাকা অর্থাৎ মিনার ছোট মামা দুবাই থেকে দেশে ফিরবেন। তখনই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হবে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মিনাদের গ্রামে অনেক বড় মেলা বসে। বাঙালি ঐতিহ্য উদযাপনে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে। গানের আসর, লাঠিখেলা প্রভৃতি মেলার মূল আকর্ষণ। লাঠিখেলা দেখে মিনা আর রতন নাগরদোলায় উঠল। দুলতে গিয়ে হঠাৎ ভয় পেয়ে রতনকে জড়িয়ে ধরে মিনা। রতন লাজুক হেসে মিনাকে আগলে রাখে পরম মমতায়। তারপর ওরা দু’জন একটি অস্থায়ী রেস্টুরেন্টের নিরিবিলি টেবিলে গিয়ে বসে। মিনার পছন্দমতো খাবারের অর্ডার দেয় রতন। খাওয়ার মাঝে মিনা কিশোরী সুলভ নানা প্রশ্ন করে রতনকে। জিজ্ঞেস করে, ঢাকায় আপনি কি এখন রান্না করে খান? রতন হেসে জবাব দেয়, না আমাদের একজন বুয়া রাখা আছে। তিনি রান্না করে দেন। তবে তোমাকে নিয়ে গেলে আমরা ছোট একটা বাসা নেব। রতন আরও কিছু বলতে চায়। মিনা তাকে থামিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। তারপর খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। বেশ লজ্জা পেয়েছে সে রতনের শেষ কথায়। রতন খেয়াল করে দু’মাস আগের মিনা এখনকার মিনা যেন সম্পূর্ণ আলাদা। বিয়ের কথাবার্তার পর থেকেই যেন সে আগের খুনসুটি সব ভুলে গেছে। কথাও বলে মেপে মেপে । লজ্জা নারীর নিজস্ব অলঙ্কার। আপনাতেই আপ্লুত হয় রতন। মেলা থেকে ফেরার পথে হরেক রকম খাবার আর মিনার জন্য একটি মোবাইল ফোন কেনে রতন । তারপর শেষ বিকেলে বাড়ি ফেরার জন্য একটা ব্যাটারিচালিত ভ্যানে ওঠে তারা।
পরদিন সকালে রতনের ঘুম ভাঙে মিনার নতুন ফোনের প্রথম কলে। কাল সন্ধ্যায়ই মিনাকে রেখে বাড়ি চলে এসেছে রতন। রতন ফোন ধরে হাই হ্যালো বলতেই বুঝতে পারে মিনার মন ভার। কী হয়েছে জানতে চাইলে মিনা বলে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। দেখেছে দুইটা পাখি আকাশে উড়ছে। হঠাৎ শিকারির একটি গুলি এসে একটা পাখির পালকে লাগল। সাথে সাথে পাখিটি নিচে পড়ে গেল। আরেকটা পাখি ভয় পেয়ে কিচিরমিচির শব্দ করে ছুটে পালাল। শুনে রতন হেসেই অস্থির। হাসি থামিয়ে বলল, শোনো মিনা, তুমি তো অনেক নরম মনের মানুষ। ঢাকা শহরে কিন্তু নরম মানুষের পদে পদে বিপদ। তাই তোমাকে এখন থেকেই মন শক্ত করতে হবে। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। মিনা জানতে চায়, আপনি কি আজই চলে যাবেন। কাল গেলে হয় না! আজ আরেকবার আমাদের বাড়িতে আসতেন।
রতন আদরমাখা গলায় বলে, না মিনা। আজ বিকেলের লঞ্চ ধরেই ঢাকা যেতে হবে। কাল সকালে অফিসে না গেলে মায়না কেটে দেবে। তা ছাড়া প্রতিদিন তোমাদের বাড়ি গেলে লোকে কী বলবে? আগে না হয় অন্য কথা ছিল। অপেক্ষা করো সোনা, আর ক’টা দিনই তো ...।
বৈশাখীর ছুটির পর থেকে রতনের দিনগুলো খুব ভালো কাটছিল। প্রথম প্রথম মোবাইল পেয়ে মিনা যখন তখন ফোন করে। দিনে ব্যস্ত থাকলেও রাতে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে তারা।
অফিসে একমনে কাজ করে যাচ্ছে রতন। একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল সে। সহকর্মী মিঠুনের ডাকে সম্বিত ফিরে পায়। কী মিয়া, কী ভাবছেন এত? শোনেন, আজ লাঞ্চের পরে শওকত ভাই আমাদের মিষ্টি খাওয়াইব। হে নাকি নতুন বউরে ঘরে তুলছে। আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলে হাসতে থাকে মিঠুন। রতনের হঠাৎ মিনার কথা মনে হয়। আর তো কয়টা দিন। মিনাও তার ঘরে বউ হয়ে আসবে। সেও সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবে। সুখবরটা চেপে রাখতে না পেরে মিঠুনকে বলে ফেলে।
লাঞ্চ ব্রেকের আধা ঘণ্টা আগে হঠাৎ করেই একটা বিকট শব্দ কানে আসে। ভয়ঙ্কর ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল যেন পুরো বিল্ডিং। রতনসহ সবাই বসে পড়ল। মনে হলো প্রচণ্ড ভূমিকম্পের কারণে সব কিছু যেন নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে লিফটের মতো। মাথার ভেতর ঝিম দিয়ে উঠল রতনের। চার দিকে তীব্র আর্তনাদের রোল পড়ে গেল মুহূর্তেই। সবাই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে বের হতে চাইছে। একসময় ছাদের কঠিন কংক্রিট আছড়ে পড়ে মেঝেতে। পিষ্ট হতে লাগল সবাই। নিমেষেই এক মর্মান্তিক অধ্যায়ের অবতারণা ঘটল। জলজ্যান্ত মানুষগুলো মুহূর্তের মধ্যে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগল। কারও মাথা থেঁতলে গেছে, কারোবা শরীর আটকে গেছে কংক্রিটের ভরা দেয়ালের নিচে। নিজের পরিণতি ভেবে শিউরে উঠল রতন। হঠাৎ পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। অনেক কষ্টে পকেট হাতড়ে মোবাইলটা বের করে দেখল মিনার ফোন। রিসিভ করে কানে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল রতন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, মিনা তোমাকে হয়তো আর দেখতে পাব না আমি। আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেল মিনা। আমাকে তুমি মাফ করে দিও। ... আরো কি যেন বলছিল রতন, কিন্তু সেসব কথা কানে ঢুকলো না মিনার। কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল তার জীবন। বাকরুদ্ধ মিনার হাত থেকে বিছানায় পড়ে গেল রতনের দেয়া ফোনটা। চোখে সবকিছুই ঝাপসা দেখছে মিনা। কী মনে হতেই আবার ফোনটা কানে তুলে নিল সে। হ্যালো, হ্যালো... রতন কথা বলো কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। চিৎকার দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল মিনা।


আরো সংবাদ



premium cement