২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দার্শনিক কবি ও কথাসাহিত্যিক জর্জ এলিয়ট কার্ক

-

সব অর্থহীন বা বিনামূল্যে মিলে,
তোমার জীবন, জীবনের প্রতিদান...
জীবনের এই প্রকৃত সত্যের দর্শন যার কবিতায় ধ্বনিত হয়, তিনি প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক জর্জ এলিয়ট কার্ক কানাডার সংসদীয় সভাকবি বা ‘পোয়েট লরিয়েট জর্জ এলিয়ট কার্ক’ কানাডীয় সমকালীন সাহিত্য সমাজে এক বিশেষ জনপ্রিয় নাম। ২০১৬ সালে দুই বছরের জন্য তিনি কানাডার পোয়েট লরিয়েট বা সাংবিধানিক কবি রূপে এক সম্মানজনক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সাংবিধানিক এই কবিরূপে স্থলাভিষিক্ত হওয়া কানাডার সরকার কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিশেষ সম্মান রূপে বিবেচিত হয়। এই মর্মে তাঁকে কয়েকটি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই অনবদ্য কবির কবিতা ও লেখা সামাজিক চেতনা, মানবাধিকার, আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ানদের ও নিউ বরুন্সউইক অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলের আফ্রিকান অভিবাসীদের প্রতি শেতাঙ্গদের বৈষম্য ও বর্ণবাদের নির্মমতার সহিংসতার ইতিহাস ফুটে ওঠে। একই সাথে তার রচনায় ও সাহিত্য সৃষ্টিতে কানাডার প্রকৃতির বৈচিত্রম্যয়তার সাথে মানুষের জীবনের উত্থান-পতনের কঠিন ও সরলতম দিকগুলো সুস্পষ্ট রূপ লাভ করেছে। কার্ক কানাডার উইন্ডসর নোভা স্কোশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬০ সালে। তিনি ছিলেন জেরাল্ডিনে (১৯৩৯-২০০০) ও উইলিয়াম কার্কের (১৯৩৫-২০০৫) প্রথম সন্তান। তিনি কানাডার সমকালীন সাহিত্য জগতে প্রথমবারের মতো ‘আফ্রিকাডিয়ান’ বলে এক নব ধারার অবতারণা করেন, তাঁর রচনা ও সাহিত্যে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ান সংগ্রাম, বর্ণবাদের নির্মমতা, দারিদ্র্যের কশাঘাতে তবিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ােভ, হতাশা, টানাপড়েনসহ আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ানদের ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের বিভিন্ন দিক হৃদয়স্পর্শীভাবে আলোচিত হয়েছে।
জর্জ এলিয়ট কার্ক নোভা স্কোটিয়ার রাজধানী হ্যালিফ্যাক্সে তার শৈশবকাল অতিবাহিত করেন। তাঁর পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ানদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে উন্নততর ছিল। তাঁর নানা মাইলস প্লেইনস অঞ্চলের একটি দোকানের মালিক ছিলেন। আর্থিক সচ্ছলতার ফলে খানিকটা বা সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন এবং পরিবারের জন্য দৃঢ় মজবুত আবাসন তৈরি করেছিলেন। অর্থনৈতিক সমতার ফলে নানা তাঁর মা ও অন্যান্য সন্তানদের জন্য মনোগ্রাহী শিশুতোষ বিভিন্ন খেলনার জোগান ও কলেজে উচ্চতর শিার ব্যয় বহন করতে পেরেছিলেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি আরো উল্লেখ করেছিলেন, তার কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়ার আগে দূর সম্পর্কের কৃষ্ণাঙ্গ আত্মীয়দের দুরবস্থার কথা সেভাবে আলোকপাত করতে পারেননি। তার বাবার এ পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বাবার সবচেয়ে যে দিকটা পছন্দনীয় তা হলোÑ সবসময় তার বাবা নিজের বেড়ে ওঠার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা ও দারিদ্র্যপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের করুণ বাস্তবচিত্র সম্বন্ধে দুই ভাইকে অবহিত রাখতেন।
কার্ক তার সেই উপন্যাসের বিভিন্ন ঘটনায় জীবনের কঠিনতম পরো প্রতিফলন ঘটান। আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ানদের সপ্তম প্রজন্মের একজন সদস্য। বিভিন্ন ঘটনা, পর্যবেণের মাধ্যমে নিউ ব্রান্সউইক ও হালিফ্যাক্সের তাঁর নিকটাত্মীয়দের সামাজিক বৈষম্য, বর্ণবাদের কশাঘাত তার হৃদয়কে বারবার বিশেষভাবে আন্দোলিত করে। এ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘জর্জ অ্যান্ড রু’ (২০০৫) দারিদ্র্যের নির্মমতায় জর্জরিত দুই কৃষ্ণাঙ্গ ভ্রাতার জীবনের করুণ পরিণতির সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক বাস্তবধর্মী প্রোপট তুলে ধরেন। কার্কের মা শিকতার সার্টিফিকেট নিয়ে হ্যালিফ্যাক্সে শিশুদের মানসিক উন্নয়নে একটি দিবাযতœ কেন্দ্র পরিচালনা করতেন এবং বাবা উইলিয়াম একজন সাধারণ রেলওয়ে কর্মী ছিলেন। বাবা বিশেষ শৈল্পিক প্রতিভায় কাচশিল্পের ওপর তেল রঙয়ের প্রাধান্য এনে একই সাথে জল রঙের ব্যবহার চিত্রশিল্পের ভুবনে এক বৈচিত্র্যময় নব ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। বাবা-মায়ের কর্মজীবনের বিভিন্ন কঠোর ও নান্দনিক দিক কার্কের সৃষ্টিশীল কাজকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। কবি কার্ক ১৫ বছর বয়সে তার ‘স্ক্রিবলিং পোয়েট্রি’ বা অনিয়মিতভাবে আর প্রায় খাপছাড়াভাবে কবিতা লেখার অভ্যাস রপ্ত করেন।
পরবর্তীকালে কবি জর্জ এলিয়ট কার্ক ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে অধ্যয়নরত অবস্থায় আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ানদের ইতিহাস নিয়ে তার কবিতা ও লেখায় আলোচনা করেন, যা তাঁর ‘সল্ট ওয়াটার কালেকশনস’ ও ‘ডিপার ব্লুস’ (১৯৮৩)-এর মুখ্য বিষয় ছিল। এলিয়ট কার্ক ওয়াটারলুতে একটি পত্রিকার সম্পাদক রূপে দীর্ঘ সময় কর্মরত ছিলেন, কানাডার রাজধানী অটোয়ার সংসদীয় সভাকবী রূপে তিনি ১৯৯০ সালে তাঁর দ্বিতীয় রচনা ‘ওয়াইলাহ ফলস’ প্রকাশ করেন, যা পাঠক মহলে সাড়া জাগায় ও আর্চবিল্ড লাম্পম্যান পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৩ সালে তিনি কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে কানাডিয়ান স্টাডিস ও ইংরেজি বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। এ সময় সাহিত্যে-কর্মে তাঁর অনন্য নৈপুণ্যের জন্য তিনি পোর্শিয়া হোয়াট প্রাইজ ও রকফেলার ফাউন্ডেশন বেললাগিও ফেলোশিপে ভূষিত হন। তিনি তিনটি সঙ্কলন সম্পাদনা করেন এবং তাঁর নাটক ‘উম্পিটেইন অ্যাসেস’ রচনা করেন, যা ছিল এক বিশেষ মাত্রার অপেরা বা গীতিনৃত্য নাট্য। তার নাটকীয় কবিতা ‘কুবেসিত : এ জাজ ফ্যান্টাসিয়া ইন থ্রি ক্যান্টস ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। যা ২০০৪ সালে মার্টিন ডক্টর লুথার কিং জুনিয়র ও ২০০৫ সালে টরুডো ফেলোশিপ প্রাইজে ভূষিত হয়। ১৯৯৯ সালে কানাডায় সিবিসি টিভি তাঁর গীতিনাট্য ‘ওয়ান হার্ট ব্রকেন’ একটি নাট্যরূপ প্রচার করে, আর এর জন্য নাট্যরূপ রচয়িতা রূপে পুরস্কৃত হন। ২০০০ সালে রচিত তাঁর ‘এক্সেকিউশন পোয়েমস’-এর জন্য ন্যাশনাল ম্যাগাজিন গোল্ড ও গভর্নরস জেনারেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি বর্তমানে কানাডিয়ান সাহিত্যের অধ্যাপকরূপে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।
কবি জর্জ এলিয়ট কার্কের একটি অনন্য সাহিত্য সৃষ্টি ছিল exceution poems ‘এক্সেকিউশন পোয়েমস’। মূলত এই কবিতা থেকেই অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে তাঁর ‘জোর অ্যান্ড রু’ উপন্যাসের প্রোপট। জর্জ এলিয়ট কার্ক যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় ডিউক ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের আগে ১৯৯৪ সালে তার মায়ের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো ‘জর্জ এবং রু-এর জীবনী সম্বন্ধে সম্যক লাভ করেন, তারা তাঁর মায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এই দুই ভাইয়ের জীবনের নানা অসমতা ও এক বিয়োগান্তক পরিণতির কথা অবগত হওয়ার পরপরই তাঁর চিন্তার েেত্র একটি পরিবর্তন আসে। তাৎণিকভাবে তিনি তার নিজের মধ্যে এক তাড়না অনুভব করেন একটি প্রাসঙ্গিক রচনার সৃষ্টির। যা কিনা বিস্তারিতভাবে তার পূর্বপুরুষদের ও আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ান ও বর্ণবাদের ঐতিহাসিক কাহিনী সত্য ঘটনার প্রেপটকে তুলে ধরে। ঘটনাক্রমে সে সময়ের সমসাময়িক চিন্তার ফসল সফল এক গীতিনাট্য সৃষ্টির ‘বিয়াত্রিস চান্সি’ beatrice chancy কাজ সপন্ন করেছিলেন। এই নাট্যালেখ্যর মূল উপজীব্য ছিল ঊনবিংশ শতকের কল্পনা আর বাস্তবতার সমন্বয়ের যৌনতা ও বর্ণবাদের ফাঁসির রজ্জুর অনন্য এক সৃষ্টি। তার মতে, সমকালীন সমাজে সাহিত্য আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ানদের বাস্তবভিত্তিক তথ্য ও নির্যাতনের সময় তার ঐতিহাসিক উপন্যাস আফ্রিকান ইতিহাসের এক ভিত্তি বা বুনিয়াদ সৃষ্টি করবে। তার উপন্যাসের দুই চরিত্রে ও রু শেষপর্যায়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছিলেন। তাঁর কারণস্বরূপ উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ের এই দুই ভাইয়ের প্রতিদিনের হতাশা, বর্ণবাদের রূপরেখা তিনি সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বিভিন্ন আলোচনায় উল্লেখ করেছেনÑ এই উপন্যাসে সেভাবে একজন ট্যাক্সিচালককে দুই কৃষ্ণাঙ্গ ভ্রাতা নির্মমভাবে হত্যা করার বিষয়টি তিনি জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ তাঁর বাবা ট্যাক্সিচালকের পেশা কিছুটা সময় সম্পৃক্ত ছিলেন। একটি আলোচনায় তাদের নির্মম কর্মের প্রতি তিনি লজ্জিত ও অনুতপ্ত। একাধারে তিনি বলেছিলেন, জর্জ ও আর রু ছিলেন দারিদ্র্য ও বর্ণবৈষম্যের শিকার দুই নিপীড়িত তরুণের বাস্তব চিত্র। দুঃসহ প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার ওপর সবার সহানুভূতিশীল হওয়ার প্রয়োজনীতা আছে। উপন্যাসের সর্বত্রই করুণ ঘৃণা, লজ্জার এক আশ্চর্য ভারসাম্য রাখতে সম হয়েছিলেন তিনি। সঙ্গীত সবসময় তাকে অনুপ্রাণিত করত, আর কার্ক তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রুফুসের জীবনে সঙ্গীতের আগ্রহের বিষয়টির প্রতিফলন ঘটান।


আরো সংবাদ



premium cement