২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নজরুল ও ওমর খৈয়াম-এর বিদ্রোহী চেতনা

-

বিশ্বসাহিত্যে বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক যারা হোমার, গ্যাটে, শেক্সপিয়র, টলস্টয়, হাফিজ, রুমি, শেখ সাদি, ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, টি এস ইলিয়ট, হুইটম্যান রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। যাদের দ্বারা পৃথিবীতে অনেক কবি-সাহিত্যিকই প্রভাবিত হয়েছেন। আমাদের বাংলা ভাষায় অনেক বাঙালি কবিই ওমর খৈয়াম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বা খৈয়ামের ভাবসম্পদ তাদের কাব্যে গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্র-যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্র-সূর্য যখন মধ্যগগনে তখন অনেক কবিই রবীন্দ্র প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই বলয় থেকে তারা কিছুতেই যেন বের হতে পারছিলেন না। নজরুলের সমসাময়িক কবিদের ওপর রবীন্দ্র-প্রভাব এমনই প্রকট হয়েছিল যে, তিরিশের কবিরা এর বিরুদ্ধাচরণে কবিতা লেখেন। কিন্তু নজরুল এই বৃত্তের বাইরে ছিলেন। তিনি তার কাব্য-কবিতায় প্রাতিস্বিক এক পরিমণ্ডল গড়ে তোলেন, যেখানে শুধু তিনিই রাজা। রবীন্দ্রনাথ কিংবা বাঙালি আর কোনো অগ্রজ কবিদের দ্বারা নজরুল প্রভাবিত না হলেও ফারসি কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে মহাকবি হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের কথা বলা যায়। এর কারণও ছিল। নজরুল সরাসরি ফারসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন খৈয়ামের চার পঙ্ক্তির কবিতাÑ রুবাইয়াত। আর এই অনুবাদ করতে গিয়েই নজরুল ওমর খৈয়ামের ধ্যানধারণা, চিন্তাভাবনা তথা ওমর-দর্শনের সাথে পরিচিতি লাভ করে।
কাজী নজরুল ইসলাম ওমর খৈয়ামের কাব্য-অনুবাদ করতে গিয়ে সেগুলোকে ছয় ভাগে ভাগ করেছেনÑ
১. শিকায়া-ই-রোজগার অর্থাৎ গ্রহের ফের বা অদৃষ্টের প্রতি অনুযোগ।
২. হজও অর্থাৎ ভণ্ড-বকধার্মিকদের প্রতি শ্লেষ-বিদ্রƒপ।
৩. ফিরাফিয়া ও ওসালিয়া অর্থাৎ প্রিয়ার বিরহ ও মিলনবিষয়ক কবিতা।
৪. বাহারিয়া অর্থাৎ বসন্ত, ফুল, পাখি বা প্রকৃতিবিষয়ক কবিতা।
৫. কুফুরিয়া অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ কবিতাগুলো। স্বর্গ-নরক, বাহ্যিক উপাসনার অসারতা, পাপ-পুণ্যের ভয় প্রভৃতি-বিষয়ক কবিতা এর অন্তর্ভুক্ত।
৬. মুনাজাত অর্থাৎ খোদার কাছে প্রার্থনা। তবে এ প্রার্থনা সাধারণ লোকের প্রার্থনার মতো নয়, এ প্রার্থনা সুফিজমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
ওমরের আপাতধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ কবিতাগুলো বা স্বর্গ-নরক, বাহ্যিক উপাসনার অসারতা, পাপ-পুণ্যের ভয় প্রভৃতি-বিষয়ক কবিতার সঙ্গে নজরুলের সাম্যবাদী চেতনামূলক কবিতার ভাবসাদৃশ্য পাওয়া যায়। ওমর খৈয়াম যেমন সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তেমনি নজরুলও অগ্রগামী এ দ্রোহের উচ্চারণে। ওমর সমাজপতিদের উদ্দেশে বলেছেনÑ
হে শহরের মুফতি! তুমি বিপথগামী কম তো নও
পানোন্মত্ত আমার চেয়ে তুমিই বেশি বেহুঁশ হও।
মানব-রক্ত শোষ তুমি, আমি শুষি আঙুর-খুন
রক্ত-পিয়াসু কে বেশি এ দুজনের, তুমিই কও।
আর নজরুল বলেছেনÑ
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন
বেলা বয়ে যায় খায় নি কো বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।...
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন।
সমাজকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ওমর খৈয়াম। তাই সমাজপতি, শহরের মুফতি, নীতিবাগিশ, মোল্লা-মৌলবি তথাকথিত জ্ঞানী-পণ্ডিত ও দার্শনিক কারো ভণ্ডামিই তার দৃষ্টি এড়ায়নি। এদের সবার মুখোশ খুলে দিয়েছেন ওমর খৈয়াম। ফলে ধর্মগুরুরা তাকে ধর্মদ্রোহী, নাস্তিক, কাফের বলে আখ্যায়িত করে। নজরুলও এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। নজরুলের বিদ্রোহও ছিল সমাজের ভদ্রবেশধারী ভক্তদের বিরুদ্ধে। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে। অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে। এসব মুখোশধারীকে আক্রমণ করেছিল নজরুলকে। তাই ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় নজরুল বলেছেনÑ
মৌ-লোভী যত মৌলবি আর মোল্লারা কন হাত নেড়ে
দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও
যদিও শহীদ হইতে রাজি ও!
আমপারা-পড়া হামবড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে।
ওমর খৈয়াম এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কণ্ঠে বলেনÑ
খাজা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আরজি এইÑ
থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।
দৃষ্টিদোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা-সরল পথ
আমায় ছেড়ে ভালো করো ঝাপসা তোমার চক্ষুকেই।
যেসব ভণ্ড পীর-দরবেশ ধর্মীয় উপাসনার আস্তানা গেঁড়ে সরল সাধারণ মানুষদের স্বর্গের লোভ ও নরকের ভয় দেখিয়ে উদর সংস্থান করে ওমর খৈয়াম তাদের ঘৃণা করেছেন। এসব নীতিবাগিশ হয়তো অহঙ্কার করে বলবেন তারা মদপান করেন না। কিন্তু তারা এমন কিছু ভয়ঙ্কর পাপ করছেনÑ যার পাশে মাতাল-বদরা শিশুর সমান। ওমর খৈয়ামের কথায়Ñ
দোষ দিও না মদ্যপায়ীর তোমরা যারা খাও না মদ
ভালো করার থাকলে কিছু, মদ খাওয়া মোর হতো রদ।
মদ না পিয়েও হে নীতিবিদ, তোমরা যেসব করো পাপ
তাহার কাছে আমরা শিশু, হই না যতই মাতাল-বদ।
সমাজের ভণ্ডামি আর ছলচাতুরিতে কারো চেয়ে কেউ কম নয়। এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা। তাই নজরুল তার ‘পাপ’ কবিতায় কাউকেই ছাড় দেননি। তিনি কোনো লুকোচুরি না করে সরাসরি বলেছেনÑ
‘আদম হইতে শুরু করে এই নজরুল তক সবে
কম-বেশি করে পাপের ছুরিতে পুণ্য করেছে জবেহ।
বিশ্ব পাপস্থান
অর্ধেক তার ভগবান আর অর্ধেক শয়তান।
ধর্মান্ধরা শোনো
অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো।’
ওমর খৈয়ামের দর্শনের মূলে একটা গভীরতর নৈরাশ্য ও বেদনা লুকায়িত আছে। নিন্দুকেরা তাকে নাস্তিক-কাফের উপাধি দিলেও তিনি ধর্মে অবিশ্বাসী ছিলেন না। এই জীবন যদি অর্থহীন হয়, মানুষ যদি নিয়তির ক্রীড়নক হয় এবং মৃত্যুর পর যদি মানুষের কোনো অস্তিত্ব না থাকে তবে এ পৃথিবী সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? এ কারণেই তিনি বিশ্বাসীÑ
এক হাতে মোর তসবি খোদার, আর হাতে মোর লাল গ্লাস
অর্ধেক মোর পুণ্যস্নাত, অর্ধেক পাপে করল গ্রাস।
সমাজের নিন্দুকেরা নজরুলকেও নাস্তিক-কাফের উপাধি দিয়েছিল প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে। তবে ওমর খৈয়ামের মতো নজরুল এমন সংশয়বাদী ছিলেন না। তার মধ্যে সদা ক্রিয়াশীল ছিল মানবপ্রেম। মানবপ্রেমই তার বুকে জাগিয়ে দিয়েছে বিদ্রোহী চেতনা। তার প্রমাণ বিদ্রোহী কবিতার এই লাইনটিÑ
‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।’
কে কী মনে করল কী করল না, সে চিন্তা যেমন ওমর খৈয়াম করেননি তেমনি কাজী নজরুল ইসলামও করেননি। তাদের দু’জনেরই বিশ্বাস ছিল মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকলে, মানুষ মানুষকে শোষণ না করলে, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গেলেÑ সেটাই হবে প্রকৃত স্বর্গ। আর এ কারণেই তাদের বিদ্রোহ ছিল প্রচলিত জীর্ণ সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আর এ দিক দিয়েই ওমর খৈয়াম ও নজরুল ইসলামের সাদৃশ্য লক্ষণীয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement