২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলা সাহিত্যে মৌলিক কবিতা

-

বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব কতটুকু? প্রশ্নটি আমার মতো ুদ্র পাঠকের পে তোলা আদৌ সমীচীন কি না! তবুও তুলতে হচ্ছে, কারণ আমার স্বপ্ন বড়। বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমি বড় বড় স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি বিশ্বসাহিত্যের বৈচিত্র্যময় পথে বাংলা সাহিত্য নেতৃত্ব দেবে। সেটি সম্ভব? সম্ভব হলে কিভাবে সেই নেতৃত্ব আমাদের ছিনিয়ে আনতে হবে?
বিশ্বজুড়ে কোনো সাহিত্য, সংস্কৃতির ‘মৌলিকত্ব’ হচ্ছে ওই সাহিত্য নেতৃত্ব কতটুকু দিতে সমÑ তার পরিমাপক। সব দেশের সাহিত্যিক তাই তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তথ্যপ্রবাহের অবাধ বৈশ্বিক প্রোপটে কাজটি ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে। কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় নতুনত্ব, অভিনবত্ব সৃষ্টি করা অসম্ভব রকম চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের কী অবস্থা? আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস কী বলে?Ñ বিষয়টি ব্যাপক গবেষণার। গবেষণা সাহিত্য নিয়ে, সাহিত্যিকদের নিয়ে হতেই হবে। এখানে আমরা মোটাদাগে পিছিয়ে আছি। যা হোক, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং যুগবিন্যাস এর দিকে আমরা যদি অল্পবিস্তর তাকাই তাহলে আমি দৈন্যরূপ দেখি মৌলিকত্বের! আমার এই মতের সাথে অনেকে ভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন এবং এটিই স্বাভাবিক। বিতর্কও সাহিত্যকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- চর্যাপদ থেকে শুরু যা প্রায় সর্বজনস্বীকৃত। এটি প্রাচীন যুগ। এরপর মধ্যযুগ যার বিস্তার ১২০০- ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর ১৮০১ সাল থেকে বর্তমান সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ বলা হয়। প্রাচীন যুগ নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই এবং বর্তমানে বিশ্বনেতৃত্ব দিতে তা আমলযোগ্য সময়ও নয়।
মধ্যযুগের সাহিত্যধারা ছিল দেব-দেবীনির্ভর বা ধর্মনির্ভর। দেব-দেবীর গুণকীর্তন করাই ছিল এই যুগের সাহিত্যের উদ্দেশ্য। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। যেমন মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলী, জীবনী সাহিত্য, নাথ সাহিত্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ইত্যাদি। মধ্যযুগে বেশির ভাগ হিন্দু কবিরা তাদের ধর্মগ্রন্থনির্ভর কবিতা রচনা করেছেন। যেহেতু সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে তেমন বিস্তারিত ছিল না, সঙ্গতভাবেই তা এই অঞ্চলের মৌলিক সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পান্তরে এই সময়ের মুসলিম কবিরা পারস্যনির্ভর সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তারা বলতে গেলে অনুবাদনির্ভর প্রণয়কাব্য বেশি রচনা করেছেন। তাই এটিকে ‘মৌলিকত্ব’ সমৃদ্ধ সাহিত্য বলা যায় না এক অর্থে! সুতরাং মধ্যযুগের কবিতার প্রায় অর্ধেকাংশ মৌলিকত্ব দৈন্যতার রূপ।
আধুনিক বাংলা কবিতা এর সময়কাল মোটামুটি ১৮০০ সাল থেকে শুরু ধরা হয়ে থাকে। এখানে যে পরিবর্তনটি লণীয় তা হলো, মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের পারস্যনির্ভর সাহিত্যচর্চার য়িষ্ণু রূপ, তবে তা যে পথে মোড় নেয় তাও অনুবাদ ভাবধারারইÑ ইংরেজি সাহিত্যের ছোঁয়া। এখানেও মৌলিকত্বের অভাব থেকে গেল। এরপর আবির্ভূত হন মৌলিকত্ব নিয়ে বাংলা সাহিত্যের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাংলা সাহিত্যে নতুনত্ব উপহার দেন। তাকে ঘিরেই একটি বলয় গড়ে ওঠে। এই সময়টুকুই বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব বিবেচনাও সেরা যুগ। তবে এই সময়ে রবীন্দ্র-ভাবধারার বাইরে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে নতুনত্ব এবং মৌলিকত্ব দুটোই উপহার দিতে সম হয়েছেন।
রবীন্দ্রবলয় ভেঙে এরপর পঞ্চপাণ্ডব কবিরা দুর্দান্ত প্রভাবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করেন। কবিতার আধুনিকায়নে তারা শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সম হন। পঞ্চপাণ্ডবের কবিতার আধুনিকায়নে ভূমিকার পাশাপাশি তাদের মৌলিকত্ব আলোচনার দাবি রাখে। ত্রিশ দশকের কবিতায় বিষয়বস্তুর েেত্র যেমন নতুন এক অভিনবত্ব এসেছে তেমনি কাব্যশৈলীর েেত্রও অপরিমেয় বৈচিত্র্য এনেছেন তরুণ এসব কবি তাদের সৃজনশীলতায়। তবে মন ও মানসে রবীন্দ্রচেতনার দুর্দমনীয় প্রভাব অস্বীকার ও নিজস্ব কাব্যরীতি অনুসরণরত ও পাঁচ মহৎপ্রাণ কবি (পঞ্চপাণ্ডব) ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যালোকেরই নাগরিক! তাদের কবিতায় প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু তারা যেহেতু ইংরেজি কবিতার অনুকরণ বেশি করেছেনÑ তাই বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব একটু রবীন্দ্র-যুগ থেকে এই যুগে কমেছে বললে ভুল হবে না বোধ হয়!
এখানে দু’জন কবিকে স্মরণ করা উচিত একজন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং অন্যজন কবি ফররুখ আহমদ। এই দুই কবি কবিতায় ভিন্ন মাত্রা দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটাতে সম হন। দু’জন আবার রাজনৈতিকভাবে দুই মেরুতে অবস্থান করেছেন। তবে মানবিক কবিতা, অধিকারের কবিতা তাদের হাতে কণ্ঠ খুঁজে পেয়েছিলÑ এই বিবেচনায় তাদের কবিতাও নতুনত্ব এবং মৌলিকত্ব বহন করে কমবেশি। আরো একটি ধারা যা কবি জসীমউদ্দীন ও বন্দে আলী মিয়া আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেনÑ গ্রামবাংলার কবিতা : এটিও বেশ মৌলিকত্ব বহন করে বাংলা সাহিত্যে এরপর কবিতার উৎকর্ষ হয়েছে নাকি স্থির অবস্থায় আছে বিষয়টি অমীমাংসিত। অবশ্যই কবিতা উৎকর্ষ লাভ করেছে তবে মৌলিকত্ব খুব একটি বাড়েনি! কারণ এর পরের কবিরাÑ কেউ রবীন্দ্র, কেউ নজরুল, কেউ জীবনানন্দ, কেউ সুকান্ত, কেউ ফররুখকে অনুসরণ করে এগিয়েছেন।
এখন একটু উত্তরাধুনিকে তাকাই। অনেকে বলেনÑ এটি কোনো যুগই নয়। এটি অধুনিক যুগেরই বর্ধিত সময়। আবার কেউ এটিকে স্বতন্ত্র যুগবিন্যাস হিসেবেই দেখেন। তবে অনেকে একমত নাও হতে পারেনÑ এই যুগবিন্যাসটি এখনো বাংলা সাহিত্যে শৈশবকালে আছে। উত্তরাধুনিক কবিতা এর বিচার করেন পাঠকেরা। এই যুগে এক কবি অন্য কবিকে বিচার দায়ভার থেকে নিষ্কৃতি পান অথবা মতা হারান। এই সময়টিই আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে বাংলা সহিত্যের অনেক কবিই পাণ্ডিত্য দেখাতে পেরেছেন। কবিতায় নতুন নতুন উপকরণ যোগ করেছেন। আবার অনেকে তিরিশ দশকের কবিদের দ্বারা অতি মাত্রায় প্রভাবিত হয়েছেন। কবিতাকে এরা সাধারণ পাঠকের জন্য দুরূহ করে দিয়েছেন! তবে মৌলিকত্ব অন্য সাহিত্যের সাথে তুলনামূলক খুব একটি চোখে পড়ার মতো নয়। এই যুগের কবিদের মধ্যে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাওয়া কবির সংখ্যা নেহাত কম।
যা হোক, মূল বিষয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায়Ñ মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য এবং অন্যান্য কিছু ধর্মীয় কবিতা মৌলিক বাংলা কবিতা। আধুনিক যুগের রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতাও বেশির ভাগ মৌলিক। তারপরে নতুনত্ব এসেছে মৌলিকত্ব কমেছে! এতটুকু যুগবিন্যাসের পরিপ্রেেিত আমাদের পর্যবেণ।
অন্য আঙ্গিকে অর্থাৎ কবিতার ধারা অনুসারেÑ গীতিকাসমূহ, পুঁথিকবিতা, মরমিগানের কবিতা, বিভিন্ন আঞ্চলিক কবিতাগুলো প্রায় শত ভাগ মৌলিকত্ব ধারণ করে।
সুতরাং বাংলা কবিতার ইতিহাস বিবেচনায় বাংলা কবিতার মৌলিকত্ব খুব একটা কম না হলেও আরো বেশি হওয়ার দাবি রাখে। এই বিষয়ে আমাদের গবেষণাধর্মী মন নিয়ে সাহিত্য সাধনা করতে হবে। নতুন এবং মৌলিক বিষয় বৈজ্ঞানিকদের মতো নিরলস ভাবতে হবে। নতুন ধারা উদ্ভাবন মৌলিকত্ব নিশ্চিত করে। এমনকি যদি আমাদের কোনো কবি বিশ্বসাহিত্যে অনুপস্থিত এমন কোনো ধারা আবিষ্কার করতে সম হন তা হবে শ্রেষ্ঠ মৌলিক বাংলা কবিতা।


আরো সংবাদ



premium cement