২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তানিয়াকে হত্যার পাশাপাশি পরিবারটির আলোও নিভিয়ে দিলো ওরা

তানিয়ার বাবা বললেন, সে ছিল পরিবারের অন্ধকারের আলোকবর্তিকা - ছবি: সংগৃহীত

তানিয়া- বাবা মায়ের আদরের একটি নাম। তার প্রকৃত নাম হচ্ছে শাহীনূর আক্তার তানিয়া। ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখে কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের চর বেষ্টিত এলাকা বাহেরচর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্ম তার। বাবা গিয়াস উদ্দিনের বাড়িসহ মোট ৪৫ শতাংশ জমি আছে। চাষাবাদের জমি নেই বললেই চলে।

নিহত তানিয়ার পরিবারে রয়েছে আরো চার ভাই এবং এক বোন। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ হওয়ায় সবাই তাকে আদর করতো তানিয়াকে। তার বড় ভাই আক্তারুজ্জামান সংসারের অভাবের করণে পড়ালেখা তেমন করতে পারেননি। তাই কৃষিকাজ করেই কোনোমতে সংসার চালাতেন। তানিয়ার দ্বিতীয় ভাই মনিরুজ্জামান সবুজও প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে সংসারের অভাবের তারণায় ঢাকার গুলিস্থানে জুতার কারখানায় কাজ করেন। তৃতীয় ভাই শফিকুল ইসলাম সুজনও পড়ালেখায় তেমন সুবিধা করতে না পারায় ছোট এক ভাই আর দুই বোনকে পড়ালেখা করিয়ে মানুষ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে লোহাজুরীর আলী শহর বাজারে ছোট্ট একটি দোকান খুলে ব্যবসা করতে থাকেন। ব্যবসায় যা আয় হতো তা দিয়ে ছোট তিন ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের ব্যয়ভার বহন করতেন।

তানিয়ার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার বাড়ির পাশে অবস্থিত বাহেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করান। সেখান থেকে তানিয়া ২০০৫ সালে কৃতিত্বের সাথে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধার্মিক। ধার্মিক এবং লেখাপড়ায় ভালো বলেই তাকে ২০০৬ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয় নিকটবর্তী ঝিড়ারপাড় দারুল উলুম দাখিল মাদরাসায়। ২০১১ সালে ওই মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করেন। পরে তাকে উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের ফেকামারা ফাজিল মাদরাসায় আলীম শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। তিনি ২০১৩ সালে কৃতিত্বের সাথে আলীম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

তানিয়ার চতুর্থ ভাই কফিল উদ্দিন সুমন ভাই শফিকুল ইসলাম সুজন এবং বাবা গিয়াস উদ্দিনের সহযোগিতায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিনিও গাজীপুরের তায়রুন্নেছা নার্সিং কলেজ থেকে ডিপ্লোমা কোর্স শেষে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নার্সের চাকরি নেন। তার চাকরি হওয়ার পর পরিবারে কিছুটা হলেও সচ্ছলতা ফিরে আসে। তারপর সেখান থেকে ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে যোগদান করে অদ্যাবধি কর্মরত আছেন।

অন্যদিকে তানিয়ার বড় বোন রুভিয়া আক্তার এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তার বিয়ে হয়ে যায়। পরে রুভিয়ার পড়ালেখা আর হয়নি।

তানিয়া যখন আলীম পাস করেন ঠিক তখন তার গর্ভধারিনী মা হালিমা আক্তার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মেয়ে তানিয়াই মায়ের সেবা কাজ করতেন। তার মা প্রায়ই তাকে বলতেন, তুমি যেমন আমার সেবাসহ সংসারের সব কাজ করে দাও ঠিক তেমনি লেখাপড়া শিখে মানুষের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে। দোয়া করি তুমি যেন আমার স্বপ্ন পূরণ কর। মূলত তানিয়ার মায়ের এমন বাসনা থেকেই নার্সিং পড়ার সূত্রপাত।

ঢাকার ইবনে সিনা নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে তিন বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ পান। নার্সিং পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে এসে মায়ের সেবাযত্ন করতেন। ২০১৭ সালে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কৃতিত্বের সাথে ডিপ্লোমা কোর্স পাস করলে ওই প্রতিষ্ঠানেই তিনি সেবিকার চাকরি পান। চাকরি পেয়েই বাড়িতে অসুস্থ মাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়ার পরিকল্পনা করেন। এক পর্যায়ে তানিয়া এবং তার ভাই সুমন ঢাকায় বাসা ভাড়া করে অসুস্থ মাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান।

এ দিকে তানিয়া এবং তার ভাইয়ের বেতনের টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়ির সংসার চলতো। মাকে চিকিৎসা করাতে প্রায়ই নিয়ে যেত ঢাকার ক্যান্সার নিরাময় হাসপাতালে। চিকিৎসার পিছনে অনেক টাকা লাগতো। তাই বাধ্য হয়েই প্রায় সাত লাখ টাকার মতো ঋণ করতে হয়েছে, যা অদ্যাবধি পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সবাইকে কাঁদিয়ে নিহত তানিয়ার মা গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের দিন ইহজগৎ ত্যাগ করেন। তার পর থেকেই পরিবারটি অর্থনৈতিক ভাবে মারাত্মক সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে নিহত তানিয়ার গ্রামের বাড়ি বাহেরচরে গিয়ে বাবা গিয়াস উদ্দিনের সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে প্রতিবেদককে বলেন, আমার মেয়ে তানিয়া ছিল পরিবারের অন্ধকারের আলোকবর্তিকা। আমার অভাবের সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যা করার দরকার তা সবই আমার মেয়েটা করতো। তাকে বিয়ের কথা বললে সে বলতো আগে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসুক তারপর বিয়ে। কিন্তু সেই শয়তানের দলেরা আমার মেয়ের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে দেয়নি। আমি আমার মেয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।

তানিয়ার চাচা নাসির উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, এ মেয়েটি পরিবারের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক ছিল। নিজের কথা কখনো চিন্তা করতো না। সমস্ত জীবন জুড়ে ছিল শুধুু বাবা আর ভাই বোন। তার একান্ত ইচ্ছা ছিল সরকারি নার্স হওয়ার। কিন্তু একটিমাত্র ঘটনা তার জীবনের সে স্বপ্ন কেড়ে নিল। সে নিহত হওয়ায় আমাদের যে ক্ষতি হল তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আমি সরকারের প্রতি মেয়েটির ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনসহ আইনী সহায়তার দাবি জানাচ্ছি।

লোহাজুরী ইউনিয়নের বাসিন্দা ফরিদ আহমেদ বলেন, তানিয়ার মতো মিষ্টভাষী, সদালাপী মেয়ে গ্রামাঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না। সে সবার সাথে মিশুক ছিল। তাকে যারা খুন করেছে আমিও তাদের শাস্তির দাবি করছি।

তানিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঝিড়ারপাড় দারুল উলুম দাখিল মাদরাসার সুপার মো: ফরিদ উদ্দিন বলেন, তানিয়া এ মাদরাসায় থাকাকালীন সময় আমাদের খুব প্রিয় ছাত্রী ছিল। সে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতো। তাকে যারা হত্যা করেছে তাদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, গত ৬ মে বিকেলে ঢাকার ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহিনূর আক্তার তানিয়া ঢাকার বিমানবন্দর কাউন্টার থেকে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে উঠেন। বাসটি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী হয়ে বাজিতপুর রুটের পিরিজপুর পর্যন্ত চলাচল করে। বাসটি কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ড আসার পর তানিয়া ছাড়া সব যাত্রী বাস থেকে নেমে পড়েন। কটিয়াদী থেকে পিরিজপুর যাওয়ার পথে বিলপাড়গজারিয়া নামক স্থানে চলন্ত বাসে তানিয়াকে গণধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করে বাসটির ড্রাইভার, হেলপারসহ পাঁচজন। গত ৭ মে মঙ্গলবার রাতে লাশের ময়না তদন্ত শেষে মায়ের কবরের পাশে তানিয়াকে দাফন করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement
ছুটির দিনেও ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর কালিয়াকৈরে ছিনতাইকারীর অস্ত্রের আঘাতে স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাবা-ছেলে আহত কাপাসিয়ায় চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ২ রাশিয়ার ২৬টি ড্রোন ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র মাগুরায় বজ্রপাতে ২ যুবকের মৃত্যু মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ‘অস্থায়ীভাবে’ ক্ষমতায় রয়েছে : জান্তা প্রধান গাজীপুরে কাভার্ডভ্যানের চাপায় মোটরসাইকেলচালক নিহত উত্তরপ্রদেশে কারাগারে মুসলিম রাজনীতিবিদের মৃত্যু : ছেলের অভিযোগ বিষপ্রয়োগের দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস খাদে, নিহত ৪৫, বাঁচল একটি শিশু ইসরাইলের রাফা অভিযান পরিকল্পনা স্থগিত

সকল