১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

মনের দুঃখে পাকা ধানে আগুন দিয়েছি, বললেন সেই প্রতিবাদী কৃষক (ভিডিও)

কৃষক আব্দুল মালেক সিকাদার - ছবি : নয়া দিগন্ত

‘ধান না থাকলে বউ-বাচ্চা নিয়া খাবো কী, ধানইতো আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই লোকসান হইলেও কষ্ট কইরা ধান আবাদ করি।’ টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে অভিনব কায়দায় প্রতিবাদকারী সেই কৃষক আব্দুল মালেক সিকদার আক্ষেপ করে এসব কথা বলেন। প্রতিবাদী কৃষক আব্দুল মালেক সিকদার তার কষ্টের কথাগুলো তুলে ধরেন নয়া দিগন্ত’র কাছে।

সোমবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় প্রতিবাদী এই কৃষকের সাথে। তিনি বলেন, ‘পাকা ধানে আগুন দিতে আমার খুব কষ্ট হইছে। কিন্তু কী করব, কষ্ট কইরা ধান আবাদ করি, অথচ সেই ধানের ন্যায্য মূল্য পাই না। তাই মনের দুঃখে আমি এই কাজ করছি। আর ধানের দাম বাড়ানো হলেই আমার এই কষ্ট, আমার এই প্রতিবাদ সার্থক হবে।’

ধানের দাম কম থাকায় এবং শ্রমিকের দাম অনেক বেশি হওয়ায় রাগে, ক্ষোভে-দুঃখে মালেক সিকদার গত ১২ মে তার ৫৬ শতাংশ একটি জমির এক কোণে কেরোসিন তেল ঢেলে পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে প্রতিবাদ জানান। পরে আশেপাশের লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলেন। বিষয়টি মিডিয়ার কল্যাণে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরে টাঙ্গাইলের তিনটি কলেজের ১৫ জন শিক্ষার্থী সারাদেশের কৃষকদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানাতে মালেক সিকাদারের ক্ষেতের ধান কেটে দেন বিনা পারিশ্রমিকে।

পাকা ধানে অগ্নিসংযোগের পর রীতিমত হিরো বনে যান প্রতিবাদী কৃষক আব্দুল মালেক সিকদার। তার দেখাদেখি আরো কয়েকটি স্থানে পাকা ধানে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা ঘটে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য স্থানেও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখা যায় কৃষকদের ধান কেটে দিতে। মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে দেশের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। ধানের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সংগঠন পালন করে কর্মসূচি।

টাঙ্গাইল কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় এবার বোরো ধানের আবাদ হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ৭০২ হেক্টর জমিতে। ফলনও হয়েছে ভাল; কিন্ত এতে চাষীরা খুশি হতে পারেননি। খুশি হওয়ার পরিবর্তে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পাকা ধানে আগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে।

কৃষক আব্দুল মালেক সিকদার বলেন, প্রতিমণ ধানের দাম ৫০০ টাকা। অথচ একমণ ধানের উৎপাদন খরচ এক হাজার টাকার উপরে। এছাড়া বর্তমানে একজন ধানকাটা শ্রমিকের মূল্য পড়ে খাওয়া-খরচ দিয়ে কমপক্ষে একহাজার টাকা। তারপরেও শ্রমিক পাওয়া যায় না। তাই কোন উপায় না দেখে মনের দুঃখে আমি নিজের পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। যাতে ধানের দাম বাড়ানোর বিষয়টি সরকার বিবেচনা করে।

তিনি বলেন, ‘ধান আবাদ কইরা বিঘাপ্রতি লোকসান হচ্ছে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা। আমরা কৃষক মানুষ। বেঁচে থাকার জন্যতো খাইতে হবে। আর ধান আবাদ না করলে খাবো কী? এ জন্য লোকসান হইলেও কষ্ট কইরা ধান আবাদ করি। ধানের দাম কমপক্ষে একহাজার টাকা ঠিক করা উচিত।’

ধানের আবাদে যান্ত্রিকীকরণের দাবি জানিয়ে মালেক সিকদার বলেন, ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই কৃষকদের বাঁচাতে হইলে ধানের দাম বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সার, কীটনাশকসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের দাম কমাতে হবে। তাহলেই কৃষক লাভবান হবে।’

কালিহাতীর বানকিনা গ্রামের আরেক কৃষক মকবুল হোসেন ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘আমার ছয় লাখ টাকা ছিল। গত ছয় বছরে ধান আবাদ কইরা সব টাকা ফুরাইছি। এহন অন্যের জমিতে কামলা না দিলে খাইতে পারি না। ধান আবাদ কইরা আমি এহন পথের ফকির।’ তিনি বলেন, ‘ঘরের ধানের ভাত খাইয়া অভ্যাস। তাই আবাদও ছাড়তে পারি না। আঙ্গর এহন মরণদশা।’

রকিবুল ইসলাম নামে মির্জাপুরের এক কৃষক বলেন, ‘বীজতলা থেকে শুরু করে প্রতি মণ ধান ঘরে তুলতে এক হাজার টাকার উপরে খরচ হয়; কিন্তু ধান বিক্রি করছি তার অর্ধেক দামে। এবার আমরা পথে বসে গেছি।’ শুধু মালেক সিকদার, মকবুল হোসেন ও রকিবুল ইসলাম নন, তাদের মত খারাপ অবস্থা এখন সকল কৃষকের।

কালিহাতীর পাইকড়া ইউনিয়নের সিংহটিয়া ব্লকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমীর মাহমুদ সিদ্দিকী বলেন, উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধানের দাম নির্ধারণ করা উচিৎ। তাহলে কৃষক লাভবান হতে পারবে।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, এই সময়ে ধানের বাজার কিছুটা কম থাকলেও কৃষক যদি ধান সংরক্ষণ করে রাখে তবে ক’দিন পরেই অধিক মূল্য পাবে।

দেখুন ভিডিও সাক্ষাৎকার

 


আরো সংবাদ



premium cement