২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সোহেলের মৃত্যুতে পাগলপ্রায় মা

কিশোরগঞ্জে সোহেলের মায়ের আহাজারি - ছবি : নয়া দিগন্ত

বনানীর এফআর টাওয়ারে আটকে পড়া মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া কিশোরগঞ্জের মো: সোহেল রানা চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে মাকে সালাম করে বলেছিলেন, ‘দোয়া করো মা, দেশের সেবায় যেন জীবন দিতে পারি।’

২৮ মার্চ। এফআর টাওয়ারে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ভবনের ভেতরে আটকা পড়েছে শত শত মানুষ। অঙ্গার হচ্ছে কেউ কেউ। এর মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর বেরিয়ে আসার আপ্রাণ আকুতি। এই মানুষগুলোকে উদ্ধারে অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন ফায়ারম্যান সোহেল রানা। ২৩ তলা ওই ভবনে আটকে পড়া মানুষকে ল্যাডারের মাধ্যমে নামাচ্ছিলেন তিনি। 

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ফায়ারম্যান সোহেল। নিজের জীবন বাজি রেখে একের পর এক মানুষকে উদ্ধার করে নিচে নামাচ্ছিলেন। সে সময়ে ভবনের ভেতরেটা আগুনের লেলিহানে আরো উতপ্ত হয়ে উঠছিল। মানুষ জানালার গ্লাস ভেঙে মাথা বের করে বাঁচানোর আকুতি জানায়। জীবন বাঁচাতে নিচে লাফ দেয় অনেকে। এ পরিস্থিতিতে সোহেল চার-পাঁচজন আটকে পড়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিচে নামাতে চান। উদ্ধারকারী ল্যাডারটি ওভারলোড দেখাচ্ছিল। ওভারলোড হলে সাধারণত সিঁড়ি নিচে নামে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক হয়ে যায়। তাই ল্যাডারের ওজন কমাতে একপর্যায়ে সোহেল নিজেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ল্যাডার থেকে বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। এরপরই ঘটে দুর্ঘটনা, যা তার জীবনের আলো নিভিয়ে দিলো। ল্যাডারের ভেতরে সোহেলের একটি পা ঢুকে যায়। এ সময় তার শরীরের সেফটি বেল্টটি ল্যাডারে আটকে পেটে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। এরপর থেকেই সংজ্ঞাহীন সোহেল। দুর্ঘটনার পরপরই সোহেলকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রতিদিন চার ব্যাগ রক্ত দেয়া হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি হচ্ছিল না। পেটের ক্ষতের কারণে সমস্যা হচ্ছিল রানার। সিএমএইচের চিকিৎসকদের পরামর্শে গত শুক্রবার (৫ এপ্রিল) সোহেল রানাকে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৭ মিনিট) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মারা যান দেশের সেবায় নিয়োজিত এক রিয়েল হিরো। মায়ের কাছে দোয়া চেয়ে এই মৃত্যুই যেন চেয়েছিলেন সোহেল।

মৃত্যুর খবরে সোহেলের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যুতে পাগলপ্রায় মা হালিমা খাতুন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। কৃষক বাবা নুরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ। বড় বোন সেলিনা আক্তার করছেন বিলাপ। শুধু পরিবারের লোকজনই নন, এলাকাবাসীও যেন নিথর হয়ে গেছে তার এই মৃত্যুতে। সোহেলের মৃত্যুর খবরে রাতেই এলাকার লোকজন তাদের বাড়িতে এসে ভিড় জমায়। সকাল থেকে দূর-দূরান্তের মানুষ এসে ভিড় করছেন তাদের বাড়িতে। 

সোমবার বিকেলে সোহেলের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামে সোহেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কিছুতেই কান্না থামছে না সোহেল রানার মা হালিমা খাতুনের। চার দিকে কান্নার রোল। প্রিয় ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে বুক চাপড়ে মাতম করছেন ছোট দুই ভাই ও একমাত্র বোন। এমন একজন পরোপকারী ও ভালো মানুষের মৃত্যুতে পুরো জেলার মানুষ যেন শোকাহত হয়ে পড়েছেন। 
ছোট ভাই রুবেল জানান, দরিদ্র পরিবার হওয়ায় পরিবারের সব কিছুই সোহেল দেখাশোনা করতেন। তাদের তিন ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। চাকরির ছুটিতে ভাই বেড়াতে এলে একই বিছানায় তারা ঘুমাতেন। এমন অনেক স্মৃতির কথা বললেন ছোট ভাই রুবেল ও উজ্জ্বল।
উজ্জ্বল জানান, সবশেষ গত ২৩ মার্চ বাড়ি এসেছিলেন সোহেল রানা। সেদিন ঢাকায় যাওয়ার সময় মাকে বলেছিলেন, ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে শিগগিরই বাড়ি আসবেন। তবে এবার আসছেন ঠিকই, তবে নিথর দেহে। 

মাত্র তিন বছর আগে ফায়ার সার্ভিসে ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরি নেন সোহেল। অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন। দরিদ্র পরিবারটির একমাত্র উপার্জনশীল ছিলেন সোহেল। একটি টিনের দোচালা ঘরে বাবা-মা, চাচা-চাচীসহ সবাই থাকেন গাদাগাদি করে। বাবা দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইজড। বাড়ির পাশের চৌগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেন। কিন্তু অর্থের অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না সোহেল রানার। অটোরিকশা চালিয়ে আর প্রাইভেট পড়িয়ে করিমগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ২০১৪ সালে।
পরের বছরই যোগ দেন ফায়ার সার্ভিসে। তার আয়েই চলত পরিবারের ভরণপোষণ ছাড়াও ছোট ভাইদের লেখাপড়া। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিকে হারিয়ে বিপদে পড়েছে পরিবারটি।
এলাকাবাসী জানান, সোহেল খুব অমায়িক ছিলেন। বাড়ি এলে আশপাশের লোকজনের খোঁজখবর নিতেন।

ফায়ারম্যান সোহেল রানার মৃত্যু সিঙ্গাপুরে
নিজস্ব প্রতিবেদক জানায়, বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আগুন নেভাতে গিয়ে আহত কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানা মারা গেছেন। গতকাল সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৭ মিনিট) সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। 
এর আগে গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সোহেলকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়।
গত ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নেয় ২৬ জনের প্রাণ, আহত হন কমপক্ষে ৭০ জন। অগ্নিকাণ্ডের পর কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানা ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের উঁচু ল্যাডারে (মই) উঠে আগুন নেভানো ও আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার কাজ করছিলেন। 

একপর্যায়ে সোহেলের শরীরে লাগানো নিরাপত্তা হুকটি মইয়ের সাথে আটকে যায়। তিনি মই থেকে পিছলে পড়ে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছিলেন। এ সময় তার একটি পা ভেঙে যায়। পরে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখান থেকে তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। 
এ দিকে ফায়ারম্যান সোহেল রানার লাশ গতরাতে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আনার কথা রয়েছে। গতকাল সোমবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে সিঙ্গাপুর থেকে সোহেলের লাশ ঢাকায় আনা হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে রাত ৮টায় ফায়ারম্যান সোহেল রানার লাশ ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। 

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা বলেন, সোহেলের লাশ ঢাকায় পৌঁছানোর পর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা সিএমএইচ মরচুয়ারিতে নেয়া হবে। পরে নিহতের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে আজ মঙ্গলবার ঢাকায় নামাজে জানাজার ব্যবস্থা করা হবে। এরপর সোহেল রানার লাশ গ্রামের বাড়ি পাঠানো হবে।


আরো সংবাদ



premium cement