২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘ভাতা চাই না, সম্মানটুকু ফেরত দেন’

মরহুম রফিকুল ইসলাম আশরাফী - নয়া দিগন্ত

আমাদের কোনো অভাব নেই। সরকারের কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা কিংবা ভাতা চাই না। আমার বাবার প্রাপ্য সম্মানটুকু ফেরত চাই। জীবনবাজি রেখে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু জীবদ্দশায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। অনেক চেষ্টা করেছি, বিভিন্ন দফতরে ঘুরেছি, বাবার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি আদায় করতে পরিনি। মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি না পেয়ে আক্ষেপ নিয়েই বাবা চলে গেলেন পরকালে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এমনটি মেনে নিতে পারছি না।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়নের তিনবারের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান দেলপাড়া এলাকার মোঃ রফিকুল ইসলাম আশরাফীর পুত্র রুহুল আমিন আশরাফী বৃহম্পতিবার নয়াদিগন্তকে এসব কথা বলেন। গত ১৮ মার্চ সকালে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম আশরাফী মারা যান।

রুহুল আমিন আশরাফী বলেন, আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় মর্যদায় তার দাফন হয়নি। এটা আমাদের পরিবারের চিরদিন আক্ষেপ থেকে যাবে। সরকারের কাছে আমরা ভাতা চাই না। মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে আমার বাবার মরনোত্তর সম্মানটুকু দিন।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের বৃহৎ ইউনিয়ন পরিষদ কুতুবপুরের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মোঃ রফিকুল ইসলাম আশরাফী। এছাড়া তিনি ঐ ইউনিয়নের আরো দুই দফা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দেলপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা সদস্য, ২৩ বছর ঐ স্কুলের সভাপতি ছিলেন। তিনি দেলপাড়া করবস্থানের আধুনিকরণসহ ঈদগাহের সূচনা করেন। এছাড়া কুতুবপুর ইউনিয়নের সিংহভাগ রাস্তা তিনি নিজে নির্মাণ করেন।

রফিকুল ইসলাম আশরাফী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের মেঘালয়ে প্রশিক্ষণ শেষ জীবনবাজি রেখে ২নং সেক্টরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ২নং সেক্টরে তিনি একজন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তার আইডি নং ২১৬৯৫০।

নারায়ণগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ও সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানও মোঃ রফিকুল ইসলাম আশরাফীকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনাক্ত করেন। এছাড়া যুদ্ধকালীন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসমাইল মিয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মোঃ রফিকুল ইসলাম আশরাফীকে সনাক্ত করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার প্রত্যাশা ছিল সরকার তাকে স্বীকৃতি দিবে। এরপরও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি না পেয়ে মারা গেলেন তিনি।

আরো পড়ুন : রংপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রস্তুতকারক মকবুল পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

সরকার মাজহারুল মান্নান, রংপুর অফিস, (২৩ মার্চ ২০১৮)

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রংপুরে বাংলাদেশের প্রথম যে পতাকাটি উত্তোলন করা হয়েছিল সেটি প্রস্তুত করেছিলেন লালিয়া টেইলার্সের মালিক মাস্টার মকবুল হোসেন। ওই পতাকা তৈরির ‘অপরাধেই’ পাক হানাদার বাহিনী তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। এরপর তিনি ভারতের সিতাই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৬ নং সেক্টরের অধীনে লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ ও আদিতমারীতে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।

কিন্তু ৪৭ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি তিনি। যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রমাণপত্র, প্রত্যয়নপত্র দিয়ে আবেদন করার পরও অজ্ঞাত কারণে রংপুর মহানগর যাছাই-বাছাই কমিটি তাকে তালিকাভুক্ত করেনি। বিষয়টি জানিয়ে তিনি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আপিল করেছেন। ৯৫ বছর বয়সে জীবনসায়াহ্নে এসে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য দৌড়ঝাঁপ এবং মানসিক টেনশনে মর্মাহত তিনি।

রংপুর মহানগরীর পায়রা চত্বরের উত্তর পাশে অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির ভেতরে লালিয়া টেইলার্সে এখনো কাজ করেন ৯৫ বছর বয়সী মকবুল হোসেন। সবাই তাকে মাস্টার নামে ডাকেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরে প্রথম যে বাংলাদেশের পতাকাটি ওড়ানো হয়েছিল তিনিই বানিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক পতাকাটি।

সেই মেশিনেই তিনি এখনো সেলাই করেন অ্যাপ্রোন। তিনি এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন রংপুরে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা তৈরি করে তা ওড়ানোর কারণে পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর নির্যাতন, ভারতে পালিয়ে গিয়ে মিত্রবাহিনীর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, তাদের সহযোগিতা করা এবং সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়ার কথা। জানিয়েছেন ৪৭ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার মনোবেদনার কথা।

মকবুল হোসেন নয়া দিগন্তকে জানান, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। তখন বেলা ১টা। তখন পায়রা চত্বরটির নাম ছিল তিনকানিয়া দালান মোড়। এই বিল্ডিংয়েই ছিল তৎকালীন রংপুর প্রেস কাব। প্রেস কাব থেকে তৎকালীন সাংবাদিক আব্দুল মজিদ, নওয়াজেশ হোসেন খোকা এবং মোজাম্মেল হক আমার টেইলার্সে আসলেন। তারা আমাকে একটি ডিজাইন দিয়ে বলেন দ্রুত একটি পতাকা তৈরি করতে।

আমি তাদের ডিজাইন মতো একটি পতাকা তৈরি করলাম। তাতে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ম্যাপ। প্রায় ৩ ঘণ্টায় পতাকাটি তৈরি করে ওই তিন সাংবাদিকসহ আমি প্রেস কাবের ছাদে গিয়ে পতাকাটি ওড়ালাম। কিছুক্ষণ পর আর্মির লোকজন এসে নামলো পায়রা চত্বরে। সোজা তারা আমার লালিয়া টেইলার্সে আসে। টের পেয়ে আমি সটকে পড়ি। তারা এসে কর্মচারীদের বলে, ‘টেইলার মাস্টার কিধার গিয়া, উসকো পাকাড়কে লেয়াও। আভি হামারা সাথ লেজাউঙ্গি ক্যান্টনমেন্ট।

আমাকে না পেয়ে তারা দুই থান কাপড় দেয়। সেটা দিয়ে পতাকা বানিয়ে দেয়ার জন্য আদেশ করে। আমার কর্মচারীরা তাদের কিছু পতাকা বানিয়ে দেয়। এরপর সেখানে ঘন ঘন আসা শুরু করে আর্মিরা। পরের দিনও এসে আমাকে খুঁজে যায়।

মকবুল হোসেন বলেন, আমি একটি শহীদ পরিবারের সন্তান। এখন আমি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। চোখেও সেরকম দেখি না। আমার সামনে এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছু হচ্ছে। কিন্তু ৪৭ বছরেও আমি মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তো দূরের কথা স্বীকৃতিটুকুও পেলাম না।

তিনি বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম প্রকাশের জন্য ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর কাছে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দিয়ে আবেদন করি। এরপর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বরাবর ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি আবেদন করে যোগাযোগ রাখি।

এরপর ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করি (ডিজি নং ১১৬৩৯৬)। কিন্তু কোনো কাজ না হওয়ায় ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিবের বরাবরে সব তথ্য-উপাথ্য দিয়ে আবেদন করি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আবার আবেদনপত্রে ‘যাচাই করে ব্যবস্থা নেবেন’ বলে নোট দিলেও এখন পর্যন্ত আমার নাম গেজেটে প্রকাশ পায়নি।

আমি আমার আবেদনের সাথে ভারত প্রেরিত নং ৩৮০৪৯, সূচক ৮৫-৪৮-৯০০৫১ সংগ্রহ করে সেটিও আবেদনের সাথে সংযুক্ত করি। কিন্তু গত বছর রংপুর মহানগর মুক্তিযোদ্ধা যাছাই-বাছাই কমিটি আমাকে তালিকাভুক্ত না করে বাদ দেয়। বিষয়টি জানিয়ে আমি গত ১৫/৫/২০১৭ তারিখে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) আপিল করি (নং ৮৬৫০)।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রংপুর জেলা ইউনিট কমান্ডের সহকারী কমান্ডার (শ্রম ও জনশক্তি), জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের প্রতিনিধি এবং রংপুর মহানগর মুক্তিযোদ্ধা যাছাই-বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্য সিরাজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, রংপুর মহানগর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির অনেকেই মুক্তিযুদ্ধেই অংশ নেননি।

ফলে এবারের যাছাই-বাছাই নিয়ে বেশ সমালোচনাও হয়েছে। লালিয়া টেইলার্সের মালিক তাদের খুশি করতে পারেননি। তিনি বলেন, ওই পরিবারে যখন তিনজন শহীদ হন তখন তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং টাপুর ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে আমি মত দিয়েছিলাম। কিন্তু অন্যরা না দেয়ায় তিনি বাদ পড়েছেন। এটা সঠিক হয়নি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিতে হবে আমাদের।


আরো সংবাদ



premium cement