২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাদ্রাসায় খুন, পরিচালকের কক্ষ থেকে জোড়া লাশ উদ্ধার

নিহত মামুনের লাশ। ছবি - নয়া দিগন্ত।

গাজীপুরের এক মাদ্রাসায় মঙ্গলবার জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। নিহতরা হলো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের চান্দনা এলাকার হুফ্ফাজুল কোরআন মাদ্রাসার পরিচালক মো. ইব্রাহিম খলিলের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার (২১) ও ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার ছয়ানি রসুলপুর গ্রামের শাহিদুল ইসলামের ছেলে ওই মাদ্রাসার নুরানী বিভাগের ছাত্র মো. মামুন (৮)। এ ঘটনায় নিহত মাহমুদার শিশু সন্তান আবু হুরায়রা (৩) আহত হয়েছে। পুলিশ এ ঘটনায় নিহত মাহমুদা আক্তারের স্বামী মাদ্রাসার পরিচালক মো. ইব্রাহিম খলিলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

নিহতের স্বামী ইব্রাহিম খলিল জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের চান্দনা এলাকার রাশেদুল ইসলাম রাজিবের বাড়ি ভাড়া নিয়ে গত এক বছর ধরে হুফ্ফাজুল কোরআন মাদ্রাসা নামের হেফজ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তা পরিচালনা ও শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানার বাশজানা মালতি গ্রামের ফজলুল হোসেনের ছেলে ক্কারী মোঃ ইব্রাহিম খলিল। টিনসেড ভবনের ওই মাদ্রাসার একটি কক্ষে দ্বিতীয় স্ত্রী মাহমুদা আক্তার (২১) এবং দু’ শিশু সন্তান আবু হুজাইফা (৫) ও আবু হুরায়রাকে (৩) নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। মঙ্গলবার ভোরে স্ত্রী মাহমুদা ও তার দুই সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে তিনি ফজরের নামাজ পড়ার জন্য পাশের কৃষি পল্লী জামে মসজিদের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হন। মসজিদে যাওয়ার সময় তিনি মাদ্রাসার দুই ছাত্র মামুন ও আব্দুল্লাহকে মাদ্রাসায় রেখে যান। ইব্রাহিম ঘর থেকে বের হওয়ার পর আব্দুল্লাহ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে টয়লেটে যায়। টয়লেট থেকে ঘরে ফিরে আব্দুল্লাহ বিছানার উপর মাহমুদা এবং দরজার সামনে মামুনের ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখে। এসময় পাশেই মাহমুদার আহত শিশু সন্তান আবু হুরায়রা (৩) কান্নাকাটি করছিল। খবর পেয়ে মসজিদ থেকে বাসায় ফিরে হতাহতদের দেখতে পান। নিহত মামুন সম্পর্কে মাহমুদার মামাতো ভাইয়ের ছেলে। এ বিষয়ে তিনি আর কিছুই জানেন না বলে জানান।

নিহত মাহমুদার বাবা আবু হানিফ গাজী ও বোন সুমাইয়া আক্তারসহ স্বজনরা জানান, চাঁদপুর জেলা সদরের খলিসাডুলি গ্রামের মো আবু হানিফ গাজী তার স্ত্রী ফাহিমা এবং তাদের তিন সন্তানের মধ্যে দু’মেয়ে মাহমুদা ও সুমাইয়াকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করতেন। হানিফ গাজীর অপর সন্তান ইব্রাহিম গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। পরিচয়ের সূত্র ধরে ওই মাদ্রাসার শিক্ষক ইব্রাহিম খলিল গত ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাহমুদাকে বিয়ে করেন। এটি যে ইব্রাহিমের দ্বিতীয় বিয়ে তা তারা জানতেন না। তাদের (ইব্রাহিম ও মাহমুদার) সংসারে দু’ছেলে সন্তান আবু হুজাইফা ও আবু হুরায়রার জন্ম হয়। মাহমুদার সঙ্গে ইব্রাহিমের দাম্পত্য সম্পর্ক খারাপ ছিলনা। বিয়ের পর গত প্রায় বছরখানেক ধরে মাহমুদা ও তাদের দু’সন্তানকে নিয়ে ইব্রাহিম খলিল এ মাদ্রাসার একটি কক্ষে বসবাস করতেন। এর আগে ২০১০ সালে ইব্রাহিম বরিশালের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ের খবর গত ৬/৭মাস আগে প্রকাশ হয়। এরপর গত মার্চ মাসে ইব্রাহিম তার নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন। কয়েক মাস আগে প্রথম স্ত্রী ইব্রাহিমকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছিল। এদিকে একই মাসে হানিফ গাজী তার স্ত্রী ফাহিমা ও তাদের মেয়ে সুমাইয়া গাজীপুরে চলে আসেন এবং স্থানীয় চান্দনা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। ফাহিমা স্থানীয় পোশাক কারখানায় চাকুরি করেন।

নিহত মামুনের বাবা শাহিদুল ইসলাম ও মা আসমা জানান, মামুনের বাবা গফরগাঁয়ের একটি ডেইরী খামারে কাজ করে। মা গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় ভাড়াবাসায় থেকে একটি পোশাক কারখানায় চাকুরি করেন। প্রায় এক বছর ধরে মামুন ওই মাদ্রাসায় লেখা পড়া করছে। শনিবার মামুন মাদ্রাসার বেতন ও হোস্টেলের খরচের টাকার জন্য রাজেন্দ্রপুরে মায়ের কাছে গিয়েছিল। পরে রবিবার বিকেলে টাকাসহ মামুনকে মাদ্রাসায় দিয়ে যান তার মা। ঘটনার রাত ৯টার সময় মামুনের সঙ্গে সর্বশেষ মায়ের কথা হয়। তখনও এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে এমন কোন আলামত বুঝতে পারেননি। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে হুজুরের মোবাইল থেকে তাকে কল করা হয় এবং তাকে দ্রুত মাদ্রাসায় আসতে বলে মোবাইল ফোনের লাইনটি কেটে দেয়। তবে কণ্ঠটি হুজুরের বলে মনে হয়নি। সন্তান নিহত হওয়ার খবর পেয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সকালেই ঘটনাস্থলে ছুটে এসে মামুনের লাশ সনাক্ত করেন শহিদ। তবে কেন মামুনকে হত্যা করা হয়েছে তা তিনি জানেন না। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবী জানান।

জিএমপি’র বাসন থানার ওসি মো. মুক্তার হোসেন জানান, মঙ্গলবার সকালে চান্দনা এলাকায় জোড়া খুনের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং নিহতদের লাশ দু’টি উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য বিকেলে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে। পুলিশ এসময় বিছানার পাশ থেকে রক্তমাখা একটি দা এবং পাশের কক্ষ থেকে দা’ ধারালো করার কাজে ব্যবহৃত একটি কাঠের খন্ড ও বালু উদ্ধার করেছে। লাশ দু’টি মাদ্রাসার পরিচালক মো. ইব্রাহিম খলিলের বসত ঘরে পড়েছিল। নিহত মাহমুদার গলায়, গালে ও কানে এবং মামুনের ঘাড়ে, মাথায় ও পিঠে ধারোলো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এছাড়াও আহত শিশু আবু হুরায়রার ডান হাতের আঙ্গুলে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পুলিশ এ ঘটনায় নিহত মাহমুদা আক্তারের স্বামী মাদ্রাসার পরিচালক মো. ইব্রাহিম খলিলকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

এব্যাপারে বাসন থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা এসআই আল আমিন মাদ্রাসার ছাত্র সাব্বিরের বরাত দিয়ে জানান, সোমবার রাতে হুজুরকে (ইব্রাহিমকে) উদ্ধার হওয়া দা’টি ধার দিতে দেখেছে। আর মঙ্গলবার ভোরে ফজরের নামাজে যাওয়ার আগে সাব্বিরকে দিয়ে মাদ্রাসার অন্য কক্ষ থেকে মামুনকে (নিহত) হুজুরের কক্ষে ডেকে আনায়। এসময় অন্য শিক্ষার্থীরা নামাজের জন্য মসজিদে চলে যায়। মাদ্রাসার পরিচালক ইব্রাহিম খলিল এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও ঘটনার ব্যাপারে আরো তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের পর ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান জানান, ডাবল মার্ডারের খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ, সিটি ডিবি, পিআইবি, সিআইডি ও ক্রাইম সিনেরসহ র‌্যাবের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছেন ও তদন্ত করছেন। ইতোমধ্যে ঘটনার ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্যসূত্র পাওয়া গেছে। সেগুলোর ব্যাপারে আরো খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। তবে প্রাথমিকভাবে সন্দেহের তীর নিহত মাহমুদার স্বামী ইব্রাহিমের দিকেই রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৬ সেপ্টেম্বর (রবিবার) নবগঠিত গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) এর কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের একদিন পরই মঙ্গলবার জোড়া খুনের এ ঘটনা ঘটেছে।


আরো সংবাদ



premium cement