২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ইরানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

-

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তেহরানের ওপর চাপ বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। এ ঘটনায় তেহরানের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করা হয়েছে। একই সাথে জানানো হয়েছে, যত দিন পর্যন্ত এ ঘটনার সব উত্তর ইরান না দেবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের ছাড়াও হবে না।
ইরান ছাড়াও পাঁচটি দেশের যাত্রী ছিলেন ইউক্রেনের ওই বিমানে। গত ১৬ জানুয়ারি লন্ডনে কানাডার দূতাবাসে মিলিত হয়েছিলেন কানাডা, ইউক্রেন, সুইডেন, আফগানিস্তান ও ব্রিটেনের প্রতিনিধিরা। মৃত যাত্রীদের প্রতি শোকপ্রস্তাব জানিয়ে তারা একটি বৈঠক করেন। পরে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে তারা জানান, মৃত যাত্রীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তেহরানকে। একই সাথে একটি নিরপেক্ষ তদন্তের সুযোগ করে দিতে হবে। যে তদন্তে অংশ নেবেন এই পাঁচটি দেশের প্রতিনিধি। তাদের বক্তব্য, শেষ পর্যন্ত বিমানে হামলা চালানোর বিষয়টি ইরান স্বীকার করলেও এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর তারা দিচ্ছে না। যতদিন পর্যন্ত সে সব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া যাবে, ততদিন তেহরানের ওপর চাপ বজায় রাখা হবে।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইরাকে ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। যাকে ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রত্যুত্তরে ইরাকে মার্কিন সেনা ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান। তখনই তেহরান থেকে উড়া একটি ইউক্রেনের বিমানও ক্ষেপণাস্ত্রে ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে অবশ্য ইরান ক্ষেপণাস্ত্রের কথা অস্বীকার করে। জানিয়েছিল, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই বিমানটি ভেঙে পড়েছে। কিন্তু পরে তেহরান স্বীকার করে নেয়, ক্ষেপণাস্ত্র লেগেই বিমানটি ধ্বংস হয়েছে। তার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল।
ইরানের বিবৃতিতে বলা হয়, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ সাইটের কাছাকাছি যাত্রীবাহী বিমানটি চলে এলে ‘মানব ত্রুটি’র কারণে বিমানটি ভূপাতিত হয়। বিমানটিকে ‘শত্রু টার্গেট’ মনে করে ভুল করা হয় এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এ ঘটনায় জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। এক টুইটে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, বিমানটির ‘ভয়ঙ্করভাবে বিধ্বস্ত’ হওয়ার ঘটনা ‘ক্ষমার অযোগ্য ভুল’। এক টুইটে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের হঠকারিতা’ ইউক্রেনীয় বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
ইরানের সামরিক বাহিনী সম্প্রতি যে অভিযোগ অস্বীকার করেছিল, ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তা থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে এলো। বিমানটি বিধ্বস্তের পর ইরানের বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা সিএওইর প্রধান আলি আবেদ জাদেহ বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে যে বিষয়টি পরিষ্কার এবং আমরা যা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তা হলো-বিমানটিকে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেনি।’ পরে ইরান সরকারের মুখপাত্র আলি রাবেই অভিযোগ তোলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে ‘মিথ্যাচার করছে এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।’
কিন্তু প্রমাণাদি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পক্ষে জোরালো হওয়ায়, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বানও জোরালো হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, তেহরানের রাতের আকাশে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে এবং একটি বিমানের সংস্পর্শে আসার পর সেটি বিস্ফোরিত হচ্ছে। এর ১০ সেকেন্ড পর বিস্ফোরণের বিকট শব্দ মাটি থেকে শোনা যায়। আর আগুন ধরে যাওয়া বিমানটি উড়তে থাকে।
ইরান এ ঘটনার পূর্ণ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে। পাশাপাশি তারা তদন্তে অংশ নিতে ইউক্রেন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান দুর্ঘটনার তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তবে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া ফিলিপ শ্যাম্পেন ইরানকে হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘বিশ্ব নজর রেখেছে’ এবং বিমানে থাকা নিহত আরোহীদের স্বজনেরা ‘সত্য জানতে চান’। এর আগে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ‘একাধিক সূত্র থেকে যেসব গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছি তা এটাই নির্দেশ করে যে, ইরানের ভূমি থেকে আকাশে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়েছে বিমানটি।’
গত ৭ জানুয়ারি ১৭৬ জন যাত্রী নিয়ে ইউক্রেনের ওই বিমানটি তেহরানের ইমাম খামেনি বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয়। ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭ বিমানটি তেহরান থেকে কিয়েভ যাচ্ছিল। যাত্রীদের মধ্যে ইরানের ৮২ জন, কানাডার ৬৩ জন, ক্রুসহ ইউক্রেনের ১১ জন, সুইডেনের ১০ জন, আফগানিস্তানের চারজন, ব্রিটেনের তিনজন ও জার্মানির তিনজন নাগরিক ছিলেন।
কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এখন বন্ধ। বিমান বিধ্বস্তের কারণে এক সপ্তাহের মধ্যে বদলে যায় ইরানের চিত্র। সাধারণ মানুষ পথে নেমেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। কারণ মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছিলেন কাসেম সোলাইমানি। সোলাইমানি হত্যার জবাবে ইরানও ইরাকে মার্কিন সেনা ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। সাধারণ মানুষ তাতেও সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা হয় তার পরই। ইউক্রেনের বিমান দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করে নেয়ায় খামেনি সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে ইরানের জনগণ। স্লোগান উঠে, ‘শত্রু আসলে বাইরে নয়, দেশের ভেতরেই।’ খামেনি সরকারের পদত্যাগের দাবি করে তারা। তবে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরকারও কড়া পদক্ষেপ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘিরে ফেলে সেনাসদস্যরা। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে চালানো হয় কাঁদানে গ্যাস। ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জও হয়।
এখন বিক্ষোভ কমলেও বিক্ষোভকারীদের সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘ইরান সমস্যার সমাধানে বোঝাপড়ায় আসতে চাইলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের সাথে যেন খারাপ ব্যবহার করা না হয়।’
দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর ইঙ্গিত ইরানও দিয়েছে। তবে বিক্ষোভকারীদের সাথে শেষ পর্যন্ত কী করা হবে, তা নিয়ে নিশ্চিত নয় রাজনৈতিক মহল। কিছুদিন আগেও ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছিল। বহু বিক্ষোভকারীর প্রাণও গিয়েছিল। এবারো তেমন কিছু ঘটার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
অন্য দিকে, সরকারবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেয়ার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল ইরানে অবস্থিত ব্রিটেন দূতাবাসের প্রধানকে। পরে অবশ্য তাকে ছেড়েও দেয়া হয়। ওই বিষয়টি নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেন, কিভাবে একজন দূতকে আটক করল ইরান সরকার। এ ঘটনা আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী। যুক্তরাজ্যের দূত নিজেও টুইট করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সব মিলিয়ে ইরান পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর তীব্র সমালোচনা করে তার দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। গত আট বছরের মধ্যে এই প্রথম তেহরানে জুমার নামাজে তিনি বলেছেন, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইউক্রেনীয় একটি বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনাটি ব্যবহার করে ইরানের শত্রুরা জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যাকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। ‘কাসেম সোলাইমানি হত্যার ঘটনায় আমরা যতটা দুঃখিত হয়েছি, বিমান ধ্বংসের ঘটনায় আমাদের শত্রুরা ততটাই খুশি হয়েছে। তারা আমাদের বিপ্লবী গার্ড ও সশস্ত্রবাহিনীকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটা সুযোগ পেয়ে গেছে।’
হাজার হাজার মানুষের সামনে দেয়া ভাষণে তিনি গুলি করে ইউক্রেনের বিমান ফেলে দেয়াকে একটি ট্র্যাজেডি বলে বর্ণনা করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আয়াতুল্লাহ খামেনির কথায় স্পষ্ট, নানা অস্থিরতা সত্ত্বেও ইরান সরকার তাদের বর্তমান ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে চায়। সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা যেসব দাবি জানাচ্ছে, তাদের ছাড় দেয়ার কোনো ইচ্ছা কর্তৃপক্ষের নেই। তেহরানে জুমার নামাজে ইমামতি করার একটি প্রতীকী তাৎপর্য আছে। ইরানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ যখন জনগণকে কোনো বার্তা দিতে চান, তখন তারা এ উপলক্ষটি বেছে নেন। তবে সাধারণত এমন সব ধর্মীয় নেতাদেরই এই কাজটির দায়িত্ব দেয়া হয় যাদের উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী বক্তৃতা দেয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু ইরান এখন যে অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজেই সেই দায়িত্ব পালন করলেন। আয়াতুল্লাহ খামেনির বক্তব্যে তিনি ইরানে জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দেন এবং মার্কিন নেতাদের তিনি ভাঁড় এবং মিথ্যাবাদী বলে নিন্দা করেন। তার ভাষণে আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্র।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, ইরানের বিক্ষোভকারীদের এবার সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। অতীতে আরব বসন্তের সময় যে কাজ তারা করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। সব মিলে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে ইরানকে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩

সকল