২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ এবং দারিদ্র্যের বাস্তবতা

-


সৌদি আরবকে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ বলেই জানে সবাই। পৃথিবীতে সব মিলিয়ে যে পরিমাণ তেল সঞ্চিত আছে, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ তেলই আছে সৌদি আরবে। মরুময় এ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এ তেলসম্পদই। প্রকৃতি থেকে পাওয়া তেলসম্পদে যে কয়টি দেশ ধনীর তালিকায় উঠে এসেছিল, তার মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম। তবে প্রকৃতিপ্রদত্ত সে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকায় অনেক দেশই তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কারণ কয়েক বছর ধরে হঠাৎ করেই তেলের দাম কমতে থাকায় অনেক দেশই বাজেট সঙ্কটে পড়ে যায়। ফলে তারা তেলনির্ভর অর্থনীতির বিকল্প কিছু ভাবতে শুরু করে এবং সেই হিসেবে দেশের খোলনলচে পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। কুয়েত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই সে পথে পা দিয়েছে অনেক আগে। সে হিসেবে সৌদি কাজটি শুরু করে তুলনামূলক অনেক পরে। দেশটির মোট আয়ের ৭০ শতাংশ আসত তেল থেকে। কিন্তু দাম কমার ধাক্কায় সৌদি আরবও একসময় ওই বিকল্প পথে হাঁটতে বাধ্য হয়।
বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল ঘোষণা করেন ভিশন-২০৩০। সে পরিকল্পনাজুড়ে রয়েছে সৌদি আরবের তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতির বৈচিত্র্যময় বহুমুখীকরণ। বিভিন্ন জনসেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন ও পর্যটনকে পুরো বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা।
অবস্থানগত ও ঐতিহ্যগতভাবে সৌদি আরব কিছু সুবিধা পেয়ে আসছে সবসময়ই। তিনটি মহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বারের অবস্থানে রয়েছে সৌদি। সেই সাথে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জলপথ দিয়ে বেষ্টিত। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করার জন্য এবং দেশটিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পুরো পৃথিবীর মৌলিক প্রবেশদ্বারে রূপান্তর করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। একই সাথে মক্কাকে সুবিন্যস্ত করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা চলছে।
ভিশন-২০৩০-এ যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, তার অংশ হিসেবে ৫০ হাজার কোটি ডলার বা প্রায় ৪০ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সাড়ে ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত একটি মহানগর তৈরির পরিকল্পনা করছে সৌদি সরকার, যা মিসর ও জর্দান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মতে, এটা হবে গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি গবেষণার রাজধানী, উদারনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা, ট্রাফিক জ্যামহীন, টেকসই শক্তিচালিত এক উত্তরাধুনিক শহর। এর জন্য প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। এই প্রজেক্টের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০২৫ সাল। এ ছাড়াও প্রায় ৮০টি বৃহৎ প্রজেক্টের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা শেষ করা হবে ২০৩০ সালের ভেতর। এ ছাড়া ভিশন-২০৩০-এর আওতায় একটি পর্যটন প্রকল্প শুরু করেছে সৌদি আরব। এর আওতায় রয়েছে ১০০ মাইল দীর্ঘ বালুকাময় উপকূল ও ৫০টি দ্বীপের একটি উপহ্রদ। সব মিলিয়ে সৌদিতে ভিশন-২০৩০ মানে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ, যা পাল্টে দিতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির পুরো অর্থনৈতিক চেহারাই।
সৌদির বর্তমান জাঁকজমকপূর্ণ চেহারা বা ভবিষ্যতের আরা জৌলুসপূর্ণ চেহারার নিচে কিন্তু দারিদ্র্যের একটি বড় ধরনের ছায়া রয়েই গেছে। দেশটিতে সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের কোনো খরচ লাগে না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অন্যান্য ব্যয় বহন করতে না পারায় অনেকে সৌদি নাগরিক তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে পারেন না। আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য দেয়া হলেও সে জন্য যে প্রক্রিয়া পার হয়ে যেতে হয়, দরিদ্র শ্রেণীর অনেকের পক্ষেই তা পার হয়ে ওই সাহায্য পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। আবার এসব সাহায্য জমা হবে যে অ্যাকাউন্টে, তার ন্যূনতম জমার সে অর্থ না থাকায় অনেক মানুষের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই।
সৌদির জৌলুসপূর্ণ শহরের বাইরে বস্তিও রয়েছে, যেখানে যেমন পানীয় জলের সঙ্কট রয়েছে, তেমনি রয়েছে পানি নিষ্কাশনের সমস্যাও। বৃষ্টি হলেই পানিতে ভেসে যায় এসব এলাকা। এসব এলাকায় এ ধরনের লাখ লাখ লোকের বাস, দীর্ঘ দিন ধরে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রেই তাদের বাস।
বিভিন্ন সময়ে করা জরিপ অনুযায়ী, সৌদির তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষের ২০ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এসব মানুষের অবস্থার উন্নয়ন সরকারের দায়িত্ব হলেও এতে মূল বাধা আসে সরকারের পক্ষ থেকেই। কারণ ক্ষমতাসীনরা এসব গরিব মানুষের অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায় না। কারণ যদি তাদের গরিব বলে মেনে নেয়া হয়, তা হলে বৈষম্য কমানোর ব্যবস্থা যেমন নিতে হবে, তেমনি দারিদ্র্য নিরসনে ধনীদের ওপর বেশি হারে করারোপ করতে হবে। কিন্তু সরকার এটি করে ধনী সম্প্রদায়কে খেপিয়ে তুলতে চায় না। আবার এসব বিষয় প্রকাশ করাতেও সৌদি সরকারের কড়াভাবে নিষেধ রয়েছে।
সৌদি সরকারের কর্মসূচিতে এসব দরিদ্রের জন্য জায়গা যেমন কম, তেমনি এদের ব্যাপারে খোলামেলাভাবে কিছু বলতেও তাদের আপত্তি রয়েছে। কারণ সে ক্ষেত্রে আয় বৈষম্য, দরিদ্র কল্যাণসহ আরো বহু বিষয় তাদের সামনে এসে যাবে, যা মেনে নিতে তারা প্রস্তুত নয়। বরং বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব প্রচার বা তথ্যচিত্র তৈরির কারণে বেশ কয়েকজনকে বড় ধরনের শাস্তি দিয়েছে সৌদি প্রশাসন।
এ অবস্থায় ভিশন-২০৩০ দরিদ্রদের জন্য বিশেষ কোনো উৎসাহ বয়ে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং তাদের শঙ্কা, এ ভিশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ যে কড়াকড়ি আরোপ করতে যাচ্ছে, তা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীকে আরো দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
২০০২ সালে তৎকালীন যুবরাজ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ রিয়াদের কিছু দরিদ্র এলাকা পরিদর্শন করার পর দারিদ্র্য দূরীকরণে কিছু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হাতে নিয়েছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি বাদশাহ হওয়ার পর জাতীয়ভাবে তাদের জন্য আরো কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেন, যেগুলোর মাধ্যমে শ্রম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলোতে মাসিক ও এককালীন অর্থ বিতরণ শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেসব প্রকল্প দারিদ্র্য বিমোচনে শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। দরিদ্র গোষ্ঠীর প্রত্যাশা ছিল, এসব প্রোগ্রাম আরও বিস্তৃত হবে। কিন্তু নতুন প্রশাসনে ওই প্রকল্প আমলাতান্ত্রিক বাধায় আর এগোতে পারেনি।
২০১৩ সালের জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গত এক দশকে সৌদি সরকার গৃহীত দারিদ্র্যবিরোধী পদক্ষেপগুলো সবচেয়ে অদক্ষ, অস্থিতিশীল ও দুর্বল। সর্বোপরি এসব প্রকল্প সমাজের সবচেয়ে বেশি দুস্থ ও অসহায় শ্রেণীকে সামাজিক সুরক্ষা দিতেই ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১৬ সালে সৌদি সরকারের ধারণামতেই, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে জীবন-জীবিকা বাঁচাতে ১০ লক্ষাধিক লোক দেশ ত্যাগ করেছে।
ভিশন ২০৩০-এর মধ্য দিয়ে অনেকখানি এগিয়ে যেতে চাইছে সৌদি আরব। কিন্তু জনসংখ্যার ২০ শতাংশকে সে হিসাবের বাইরে রেখে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই দুষ্কর। তাই হয়তো এদের সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নয়তো উন্নয়নের সে গতিধারা এদের জন্যই যাবে আটকে।


আরো সংবাদ



premium cement