২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারাক্রান্ত ন্যাটো

-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ীপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে দেশটির প্রভাব ও বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই ১৯৪৯ সালে জন্ম হয়েছিল নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটোর। সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল, উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা, অভিন্ন ঐতিহ্য এবং সভ্যতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ন্যাটোভুক্ত যেকোনো দেশের ওপর সশস্ত্র হামলা হলে সেটি জোটভুক্ত সব দেশের ওপর হামলা বলেই গণ্য হবে এবং সব দেশ একে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। প্রতিষ্ঠাগত কারণেই সংস্থাটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদকে নিজেদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করত। প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই বছর ন্যাটো একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ছিল, কিন্তু কোরীয় যুদ্ধের পর ন্যাটো সদস্যরা চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন সর্বোচ্চ সামরিক কমান্ডারের অধীনে একটি সমন্বিত সামরিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। ১৯৪৯ সালে ন্যাটোর প্রথম মহাসচিব লর্ড ইসমে বলেন, ন্যাটোর মূল কাজ হবে রাশিয়াকে দুর্বল করা, যুক্তরাষ্ট্রকে সবল বা শক্তিশালী করা এবং জার্মানির পতন ঘটানো। সাত দশকে এ লক্ষ্য কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে সংস্থাটি। নাকি যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ও ভারে কেবলই আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এ সংস্থা।
বর্তমান দ্বন্দ্ব ও কারণ : মূলত ন্যাটো জোটের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন আমেরিকার সর্বোচ্চ প্রধান সামরিক নেতা। বলা যায় ন্যাটো হচ্ছে আমেরিকা নামক মুদ্রাটির এপিঠ-ওপিঠ। আমেরিকা ছাড়া ন্যাটো আসলে বুলেটবিহীন পিস্তলের মতোই। মূলত ন্যাটো জোটটি সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্র এক দিক দিয়ে তারা যেমন নিজের আধিপত্য বজায় রাখছে, অন্য দিকে যুদ্ধ-সঙ্ঘাত ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে চালাচ্ছে অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তির বাণিজ্য করে। কয়েকটি রাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা রেখে এর বিনিময়ে তারা অর্থ হাতিয়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র নিজ স্বার্থে গড়া এ সংস্থায় একাই ৭০ শতাংশ অবদান রাখলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ ব্যাপারে অন্যদের বেশ চাপে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান করেছেন তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট দেশের জিডিপির ৪ শতাংশ করতে। প্রতিরক্ষা বাজেট এতটা বৃদ্ধি করতে হলে হয় বিপুল হারে যেকোনো দেশেরই ট্যাক্স বাড়াতে হবে; নয়তো শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যাপকভাবে বরাদ্দ হ্রাস করতে হবে অথবা দু’টিই করতে হবে। যাই হোক না কেন, ওই দেশগুলোর সাধারণ মানুষকেই এর ফল ভোগ করতে হবে। তাই অনেক রাষ্ট্রই মার্কিন প্রশাসনের আদেশের সাথে একমত নয়।
এবারের সম্মেলন ঘিরে বিতর্ক : ন্যাটো প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়েছে জোটের সম্মেলন। কিন্তু গত ৪ ডিসেম্বর এ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই ন্যাটোকে একটি অকেজো সংগঠন আখ্যা দিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সূচনা করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তিনি মনে করেন, ন্যাটোর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা দেশ যুক্তরাষ্ট্র জোটের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছে। তিনি ন্যাটোর সমালোচনায় ব্যবহার করেন ‘ব্রেন ডেথ’ শব্দটিও। ম্যাক্রোঁর অভিযোগ, অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে পাশ কাটিয়ে ন্যাটো পরিচালনা করা হচ্ছে। সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার, তুরস্কের অভিযান ইত্যাদি কারণেই ন্যাটো তার তোপের মুখে পড়ে। তার এ পর্যবেক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেল ন্যাটো বিষয়ে ম্যাক্রোঁর বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। মারকেল বলেন, ফরাসি প্রেসিডেন্টের এ ধরনের মন্তব্যের সাথে আমি সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। ন্যাটো প্রধান জেনস স্টোলেনবার্গও ম্যাক্রোঁর মন্তব্যের কড়া নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অতীতে ন্যাটো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন, দীর্ঘ সোভিয়েত দখলদারিত্ব রুখে দিতে ন্যাটো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে তিনি বলেন, ন্যাটো তার ইউরোপীয় মিত্র, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের সাথে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্য দিকে সব তিক্ততা ভুলে জোটের নীতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন স্বাগতিক দেশ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ন্যাটোকে ‘ঐক্যের বৃহত্তম বলয়’ অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, জোটটি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। যত দিন আমরা একত্রে থাকব, তত দিন আমাদের হারানোর স্বপ্ন দেখবে না কেউই।
পাল্টেছে লক্ষ্য : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইউরোপের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিলে গঠন করা ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্য ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরোধ করা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে লক্ষ্য পাল্টেছে। রাশিয়ার চেয়ে চীনই অনেক ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ন্যাটোর সামনে। ন্যাটোর সর্বশেষ বৈঠকে অন্য সমস্যার পাশাপাশি স্থান পেয়েছে চীনের ছুড়ে দেয়া কৌশলগত চ্যালেঞ্জের বিষয়টিও। এবার প্রথমবারের মতো জোটের সামনে চীনের উত্থান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ন্যাটোর প্রধান স্টোলেনবার্গ বলেছেন, আমরা এখন স্বীকার করছি, চীনের উত্থানই সব মিত্র দেশের জন্য নিরাপত্তা প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে। অন্য দিকে বর্তমানে ন্যাটো নিয়ে সবচেয়ে সরব কণ্ঠস্বর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ কিছু দিন আগেও বলেছিলেন, নিরপেক্ষ অনুমানে এখনো ন্যাটোর শত্রু রাশিয়া। কিন্তু ২৮ নভেম্বর মালিতে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ১৩ ফরাসি সেনা নিহত হওয়ার দুই দিন পরে, তিনি জোর দিয়েছিলেন সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে। আর ৮ ডিসেম্বর এসে তিনি এক টুইটে বলেন, রাশিয়া এখনো হুমকি, তবে শত্রু নয়। বরং দেশটি নির্দিষ্ট বিষয়ে অংশীদারও।
পরিশেষে ৭০ বছর আগে যে পরিস্থিতি ও বিবেচনায় ন্যাটো গঠিত হয়েছিল, এ সুদীর্ঘ সময়ে সে পরিস্থিতি ও বিশ্ব রাজনীতি অনেকটাই পাল্টেছে। পাল্টেছে নিরাপত্তাহীনতাবোধের সেই শঙ্কাও। ফলে ২০২০ সালের মুখোমুখিতে এসে প্রশ্ন জাগছে, ন্যাটোর আদৌ কি কোনো প্রয়োজন আছে? যুক্তরাষ্ট্রের চাপের নিচে পড়ে ভারাক্রান্ত ন্যাটোর আরো এগিয়ে যাওয়া সত্যিই কি কোনো উপযোগিতা আছে? যুক্তরাষ্ট্রসহ লাভবান কয়েকটি রাষ্ট্র এটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেও সদস্য অন্য রাষ্ট্রগুলোর কি এর দ্বারা কোনো উপকার হচ্ছে? ন্যাটো নিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নেতাদের বাদানুবাদ সে প্রশ্নই বারবার তুলে ধরছে। সুতরাং ন্যাটো গঠনের পরের শতাব্দীর দুই দশক পার হওয়ার পর এখন আসলেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে, ন্যাটোকে কি ভারমুক্ত করে সময়োপযোগী নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম করে গড়ে তোলা হবে, নাকি একেবারেই বিলুপ্ত করে দেয়া হবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এ সংস্থাটিকে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি চতুর্থ দফা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি : এবারের তাপদাহ শেষেই বৃষ্টিপাতের আশা ফরিদপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজে হাজারো মুসুল্লির কান্না পোরশার নোচনাহারে আগুনে ৩টি দোকান পুড়ে গেছে খুলনা বিভাগ ও ৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ ‘১ টাকার কাজ ১০০ টাকায়, ৯৯ যায় মুজিব কোটে’ রাত পোহাতেই রুদ্ধদ্বার অনুশীলন শুরু বাংলাদেশের সাটুরিয়ায় প্রশান্তির বৃষ্টি চেয়ে সালাতুল ইসতিসকা আদায়

সকল