১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লিবিয়া : পুতিনের আরেক গিনিপিগ

-

সিরিয়াতে দীর্ঘ দিন ধরে বিদ্রোহী পক্ষ বাশার আল আসাদ সরকারকে চাপে রেখেছিল। ইরান ও লেবাননের সহায়তা থাকা সত্ত্বেও দেশের অনেক অঞ্চলে কর্তৃত্ব হারিয়েছিল সিরিয়ার সরকারি পক্ষ। কিন্তু প্রেক্ষাপটে রাশিয়া হাজির হতেই রাতারাতি পাল্টে যায় হিসাব। বিদ্রোহীরা হয়ে পড়ে কোণঠাসা।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের জেরে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে সিরিয়ার প্রভাবশালী বিরোধী-বিদ্রোহী পক্ষ। এর প্রতিদান হিসেবে সিরিয়া থেকে বড় ধরনের ফায়দা হাতিয়ে নেয় রাশিয়া।
বর্তমান বিশ্বের সেরা দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। সব সময়ই দেশ দু’টি নতুন নতুন অস্ত্র ও কৌশল উদ্ভাবন করে। বিশ্বজুড়ে ছোট-বড় অসংখ্য যুদ্ধফ্রন্ট খোলা থাকায় যুক্তরাষ্ট্র খুব সহজেই তাদের নতুন নতুন অস্ত্র ও স্ট্রাটেজি পরীক্ষা করতে পারে। কিন্তু রাশিয়ার জন্য সে সুযোগ খুবই সঙ্কীর্ণ। অবশ্য রাশিয়া কোনো সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের মতো আবেগি হয়ে যখন-তখন যুদ্ধে জড়ায়নি। কিন্তু অস্ত্র বা নতুন আবিষ্কৃত রণকৌশলের পরীক্ষার জন্য এমন প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসই দরকার। এ কারণে রাশিয়া মাঝে মধ্যেই সঙ্ঘাতে জড়ায়, কিন্তু বেশ ভেবে চিন্তে। আর ক্যালকুলেটিভ হিসাবের কারণে খরচের পরে লাভটাও তুলে নেয় নিশ্চিতভাবে। সিরিয়ায় সফল অভিযানের পর সেই রাশিয়ার বর্তমান নজর লিবিয়ার দিকে। দেশটিকে তারা ব্যবহার করতে চায় নিজেদের নতুন অস্ত্র ও স্ট্র্যাটেজি পরীক্ষার নতুন গিনিপিগ হিসেবে।
২০০৩-এ ইরাকের পর ২০১১ তে লিবিয়ায় অভিযান চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন একটি ধারণার জন্ম হয়। তা হলো কয়েক দশকের অনুপস্থিতির পর আবারো মধ্যপ্রাচ্যে পড়তে শুরু করেছে রুশ সেনাদের বুটের ছাপ। তবে আগের সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বর্তমান রাশিয়ার চিন্তায় রয়েছে ব্যাপক ফারাক। তারা এখন মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্ঘাতে অংশ নিতে চায় বড় ধরনের বাণিজ্যিক লাভের আশায়।
এ ক্ষেত্রে সিরিয়ার সঙ্ঘাতে ব্যাপকভাবে জড়াতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অনীহা রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য বড় একটি সুযোগ এনে দেয়। পুতিন তখন হোয়াইট হাউজে বসা প্রতিদ্বন্দ্বীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, তাদের একচেটিয়া আধিপত্য নিজ হাতে খর্ব করে তারা কতটা ভুল করেছে।
লিবিয়ায় বর্তমানে দু’টি সরকার বিদ্যমান। একটি ফায়েজ সিরাজের সরকার, যার নাম জাতীয় ঐক্য সরকার। এটি আন্তর্জাতিক মহল কর্তৃক মনোনীত ও স্বীকৃত। তবে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক এটি মনোনীত হলেও জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত নয়। একে ত্রিপোলির সরকারও বলা হয়। অন্য দিকে দেশটিতে পূর্বাঞ্চলভিত্তিক আরেকটি সরকার রয়েছে। এটি কিন্তু নির্বাচিত (নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদ কর্তৃক নিয়োজিত) সরকার।
দেশটির বর্তমান প্রভাবশালী নেতা ফিল্ড মার্শাল খলিফা হাফতার দ্বিতীয় সরকারের সামরিক বাহিনীর প্রধান। সাম্প্রতিক অভিযানের পর দেশটির দক্ষিণের বিস্তৃত এলাকা হাফতার বাহিনীর দখলে চলে এসেছে। লিবিয়ার বর্তমান সঙ্ঘাতে হাফতার মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্স ও রাশিয়াও তার পক্ষে রয়েছে। অন্য দিকে দুই পক্ষের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও তাকেই অগ্রাধিকার দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
খলিফা হাফতারের নাম কয়েক মাস ধরে শোনা গেলেও লিবিয়ার ইতিহাসে চার দশক ধরেই তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কখনো তিনি ছিলেন লিবিয়ার ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, আবার কখনো তাকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। পরে আবার তার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে ক্ষমতার কেন্দ্রে। দীর্ঘ দিন ধরে নির্বাসিত হাফতার ২০১১ সালে লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হলে খলিফা দেশে ফিরে আসেন। গাদ্দাফি হত্যার তিন বছর পর ২০১৪ সালে খলিফা হাফতার নির্বাচিত পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান।
২০১৫ সালের মার্চে লিবিয়ার নির্বাচিত পার্লামেন্ট হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ খলিফা হাফতারকে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির অধিনায়ক নিযুক্ত করে। পরে তাকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল থেকে পদোন্নতি দিয়ে ফিল্ড মার্শাল করা হয়। ৭৫ বছর বয়সী হাফতার নিজেকে ইসলামী চরমপন্থীদের বিরোধী বলে দাবি করেন। তবে বিরোধীরা তাকে গাদ্দাফির নতুন সংস্করণ বলেই মনে করে।
বর্তমানে রাশিয়ার সেনাবাহিনী লিবিয়ায় সব কিছুর সাথেই জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কোথাও তাদের নামের দেখা পাওয়া যায় না। তবে তারা খলিফা হাফতারের পক্ষে লড়ছে এমন কিছু ডকুমেন্ট সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। গত অক্টোবরে ত্রিপোলির বাইরে বিমান হামলায় ৩৫ জন নিহতের ঘটনায় রাশিয়াকে স্পষ্টভাবে দায়ী করে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতহি বাশাঘা। তিনি বলেন, ‘লিবিয়ায় রাশিয়ার গ্রুপ ওয়াগনার যে লিবিয়ার উপস্থিত আছে, সে ব্যাপারে আমাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। তারা লিবিয়ার গৃহযুদ্ধকে স্থায়ী রূপ দিতে চাইছে। এর আগে তারা সিরিয়া, মধ্য আফ্রিকায় গিয়েছিল, সেখানে তারা সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।
মূলত লিবিয়া পরিণত হয়েছে বিভিন্ন দেশের সামরিক পরীক্ষা ক্ষেত্রে। ফ্রান্স, আরব আমিরাত, মিসরের বিশেষ বাহিনী ও বিমানগুলো সমর্থন দিচ্ছে খলিফা হাফতারকে। সুদান ও জর্দানও অবৈধভাবে হাফতারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর তুরস্ক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ত্রিপোলি সরকারকে। তা হলে রাশিয়ার উপস্থিতিও তো এ ক্ষেত্রে অপরিহার্যই। কিছু দিন আগে লিবিয়া সীমান্তের কাছে মিসরের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বিমানঘাঁটিতে বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করেছে রাশিয়া।
এ পদক্ষেপে লিবিয়ায় মস্কোর গভীর সংশ্লিষ্টতার বিষয় ফুটে উঠেছে, যা ওয়াশিংটনের জন্য উদ্বেগের। তবে শুধু লিবিয়া নয়, বরং পুরো উত্তর আফ্রিকায় রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ বাড়ছে। আগে থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের হাতকে শক্তিশালী করতে রাশিয়া সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে, যা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য বেশ অস্বস্তির কারণ। এখন হাফতারের হাতকে শক্তিশালী করতে মস্কো প্রকাশ্যে তাকে সমর্থন দিলে, তা তাদের জন্য আরো দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
এ ব্যাপারে রাশিয়া জানিয়েছে, তারা হাফতার বাহিনীকে সাহায্য করছে না এবং ওই অঞ্চলে নতুন রক্তপাত এড়াতে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার প্রতি সমর্থন রয়েছে তাদের। রাশিয়ার কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ওই সরকার ও হাফতার, উভয়ের সাথে বৈঠক করেছেন।
সিরিয়ায় যেমন বাশার আল আসাদের পক্ষ নিয়ে অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের হাত থেকে সব কিছু তার কব্জায় এনে দিয়েছিল, তেমনিভাবে হাফতার চাইছেন, আয়ত্তে আনতে না পারা ত্রিপোলি যেন তার হাতে এনে দেয় রাশিয়া। তবে লিবিয়ায় রাশিয়ার উপস্থিতি তার নিজের লাভের জন্যই। এখানে অবশ্য একটি দিক দিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। সিরিয়া প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার দীর্ঘ দিনের মিত্র তুরস্ক। কিন্তু লিবিয়ায় পুতিন যে পক্ষকে সমর্থন করছেন, তুরস্ক আগে থেকেই তার বিরোধীপক্ষ অর্থাৎ ত্রিপোলি সরকারকে সমর্থন করছে। ফলে তৃতীয় দেশের সঙ্ঘাতে দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট হওয়াকে পুতিন কতটুকু গুরুত্ব দেবেন, তা-ও দেখার বিষয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement