২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সঙ্ঘাতে হরমুজ প্রণালী

-

১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছিলেন রেজা শাহ পাহলভি। ১৯৬৪ সালে শাহের তীব্র সমালোচক কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনিকে ১৪ বছরের জন্য ইরাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে আরো ১৫ বছর পর। জনরোষের মুখে ১৯৭৯ সালে ১৬ জানুয়ারি শাহ মিসরে পালিয়ে যান। পরের মাসেই খামেনি ইরাকের নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন এবং ইরানে নতুন সরকার গঠন করেন। ইরানের ছাত্ররা শাহকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে তেহরানে অবস্থিত আমেরিকার দূতাবাসের ৬৩ জনকে ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রাখে।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। পরের বছর ইরানের সাথে বেশির ভাগ বাণিজ্য চুক্তি বানচাল করে দেয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইরানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। পরবর্তী পুরোটা সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা ইরানকে শয়তানের অক্ষশক্তির অংশ হিসেবেই গণ্য করতে থাকে। দেশটির ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টরা ইরানের ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় থাকলেও রিপাবলিক দলীয় প্রেসিডেন্টরা সব সময়ই ইরানের সাথে শত্রুতার কোনো বিকল্প দেখেননি।
তেহরান ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে সবচেয়ে ভালো আচরণ লাভ করে বারাক ওবামার সময়কালে। সে সময় তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড থামাতে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি ঐতিহাসিক এক চুক্তিও করেন। ফলে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে ইরানের অবস্থা কিছুটা ভালো অবস্থানে যাচ্ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই ইরান প্রসঙ্গে কোনো ছাড় দিতে নারাজ। ২০১৮ সালের ৮ মে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। চুক্তি প্রত্যাহারের পর ইরানের তেল বিক্রির ওপর বৈশ্বিক অবরোধ আরোপেরও ডাক দেন তিনি। তার দাবি ছিল, ওই বছরেরই ৪ নভেম্বরের মধ্যে ইরান থেকে সব দেশ যেন তেল কেনা বন্ধ করে দেয়। এ নির্দেশ অমান্য করে ইরানের সাথে যারা বাণিজ্য চালিয়ে যাবে, বিশেষ করে তেলবাণিজ্যে অংশীদার হবে, তাদের প্রতি হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন ট্রাম্প। কয়েকটি দেশকে ছয় মাস বেশি সময় দিলেও শেষ পর্যন্ত সবাইকেই ইরানের তেল ছাড়াই চলতে বাধ্য করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
স্বভাবতই ইরান বিষয়টিকে সহজভাবে নেয়নি। কারণ ইরানের মোট রফতানি আয়ের দুই-তৃতীয়াংশই আসে জ্বালানি তেল বিক্রির মাধ্যমে। ইরানের অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন এ তেল বিক্রিতে বাধা আসায় স্বাভাবিকভাবেই তারা একটি প্রতিরোধের জায়গা খুঁজে বের করে। সে কারণেই ওই সময়ে দেয়া এক পাল্টা হুমকিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছিলেন, আমেরিকানরা ইরানের তেল রফতানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু তারা নিজেরাই এ দাবির অর্থ অনুধাবন করতে পারছে না। কারণ এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে তেল রফতানি চালু থাকবে, আর ইরানের তেল রফতানি বন্ধ থাকবে, এটা হতে পারে না। আর এ ক্ষেত্রে ইরানের হাতের তুরুপের তাস হচ্ছে হরমুজ প্রণালী। পরমাণু ইস্যুতে ইরানের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে এ সমুদ্রপথটিকে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে তেহরান।
হরমুজ প্রণালী হচ্ছে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের মধ্যকার একটি প্রণালী। পৃথিবীর ৪০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল এ পথ ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় যায়। শুধু ইরানই নয়, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোও তাদের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানির জন্য হরমুজ প্রণালীর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। আবার এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশও তেল আমদানির জন্য এ রুটটিকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়।
এ প্রণালীর একদিকে আছে আমেরিকার মিত্র আরব দেশগুলো। অন্য পাশে রয়েছে ইরান। হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সঙ্কীর্ণ যে অংশ সেখানে ইরান ও ওমানের দূরত্ব মাত্র ২১ মাইল। এ প্রণালীতে জাহাজ চলাচলের জন্য লেন রয়েছে দুটো এবং প্রতিটি লেন মাত্র দুই মাইল (তিন কিলোমিটার) প্রশস্ত। হরমুজ প্রণালীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ আকারে অন্যান্য রুটের চেয়ে সঙ্কীর্ণ হলেও জ্বালানি তেল বহনের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ চলাচল করার পক্ষে এটি যথেষ্ট গভীর ও চওড়া।
পৃথিবীতে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল রফতানি হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই যায় এ হরমুজ প্রণালী দিয়ে। প্রতিদিন এক কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল তেল রফতানি হয় এ পথ ব্যবহার করে। অন্য দিকে, মালাক্কা প্রণালী দিয়ে জ্বালানি তেল রফতানি হয় এক কোটি ৬০ লাখ ব্যারেল এবং সুয়েজ খাল দিয়ে প্রতিদিন ৫৫ লাখ ব্যারেল তেল রফতানি হয়। সব মিলিয়ে ইরানের এবং পুরো বিশ্বের তেল রফতানি তথা অর্থনীতির জন্য এ প্রণালীটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা এলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যেরই তেল রফতানি স্থবির হয়ে যাবে। আর তেল পরিবহন কমলে বেড়ে যাবে দাম। এতে ঝামেলায় পড়বে চীন, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার বড় বড় তেল আমদানিকারক দেশ। সমস্যা সৃষ্টি হবে অন্য সব দেশেও। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সঙ্কট জটিল হয়ে ক্রমেই বৈশ্বিক রূপ ধারণ করবে। আবার এটি পারস্য উপসাগর থেকে মুক্ত সাগরে যাওয়ার একমাত্র সাগরপথও। ফলে এ পথটি সঙ্কীর্ণ হলেও এর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক।
ইরানের দাবি, মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত জলপথ হরমুজ প্রণালী ও পারস্য উপসাগরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাদের হাতে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিরোধে ইরান তার এ অস্ত্রটিই ব্যবহার করছে। ইরান বলেছে, তাদের তেল রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি বাধা দেয়, তাহলে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে কোনো তেল রফতানি করা যাবে না। হরমুজ প্রণালী দিয়ে যত তেল পরিবহন করা হবে সেটি তারা বন্ধ করে দেবে।
সাম্প্র্রতিক পরিস্থিতি
মূলত গত মে মাস থেকেই হরমুজ প্রণালীতে সমস্যা শুরু হয়। ১২ মে ওমান উপসাগরের ফুজাইরাহ উপকূলে সৌদি আরবের দুটি, নরওয়ের একটি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি তেলের ট্যাংকার হামলার শিকার হয়। এর আগেই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগরে তাদের ইউএসএস আব্রাহাম লিংকন বিমান বাহক স্ট্রাইক গ্রুপ, বি-৫২ বোম্বার ও একটি আন্টিমিসাইল ব্যাটারি পাঠায়। এ হামলার ঠিক এক মাস পর ওমান উপসাগরে একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে। ১৩ জুন হরমুজ প্রণালীর কাছে জাপান ও নরওয়ের দুটি তেলের ট্যাংকার হামলার শিকার হয়। এর এক সপ্তাহের মাথায় ২০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুপ্তচর ড্রোন ভূপাতিত করে ইরান। ৪ জুলাই জিব্রাল্টারে ব্রিটিশ মেরিন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ ইরানের একটি সুপারট্যাংকার জব্দ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইরান হরমুজ প্রণালীতে একটি ব্রিটিশ ট্যাংকারের পথ অবরোধ করে। আক্রান্তসহ সবার দাবি, সৃষ্ট সমস্যার জন্য ইরানই দায়ী। কিন্তু ইরান এসব হামলার সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ নাকচ করে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। তবে যাই হোক না কেন, এর ফলে পরিস্থিতি অনেকটাই ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে?
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া বাকি দেশগুলো ইরানের সাথে কোনো রকম সঙ্ঘাতে যেতে চায় না। এ ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইরান কি তাদের দাবি অনুযায়ী হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারবে?
১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত জাতিসঙ্ঘের সমুদ্র আইন সম্পর্কিত কনভেনশন অনুযায়ী, একটি দেশের তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সেই দেশের সমুদ্রসীমা হিসেবে বিবেচিত হবে। সে হিসেবে পারস্য উপসাগরে যেতে যেসব জাহাজ, ট্যাংকার উত্তর ও দক্ষিণ রুট ব্যবহারে বাধ্য হয় সেগুলোকে বাধা দিতে পারে ইরান। তবে জাতিসঙ্ঘের এ সংক্রান্ত কনভেনশনের ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পারে ইরান। কারণ দেশটির সরকার ১৯৮২ সালে তাতে স্বাক্ষর করলেও সেটি কখনোই সে দেশের পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়নি। আবার এ রুট ব্যবহারে বাধা দিয়ে ইরান তার প্রতিবেশী তেল রফতানি ও তেল আমদানিকারক দেশগুলোর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি করতে সক্ষম হবে কিন্তু নিজেও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা প্রণালীর কিছু অংশ তখন ইরানও ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে শেষ পর্যন্ত হরমুজ প্রণালীতে ইরানের আধিপত্য থাকবে, না ইরান বিরোধীদের প্রাধান্য থাকবে এটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তবে সব বাদ দিয়ে আগের মতোই চলুক হরমুজ প্রণালীর পানি ও জাহাজ-ট্যাংকার উভয়টি, এমনই প্রার্থনা বিশ্ববাসীর।


আরো সংবাদ



premium cement
ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী একনেকে ৮৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন সান্তাহারে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে যুবক নিহত জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের সেতু ভাঙ্গার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে! নাশকতার মামলায় চুয়াডাঙ্গা বিএনপি-জামায়াতের ৪৭ নেতাকর্মী কারাগারে হারল্যানের পণ্য কিনে লাখপতি হলেন ফাহিম-উর্বানা দম্পতি যাদের ফিতরা দেয়া যায় না ১৭ দিনের ছুটি পাচ্ছে জবি শিক্ষার্থীরা বেলাবতে অটোরিকশা উল্টে কাঠমিস্ত্রি নিহত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন

সকল