২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এবারো পাল্টানো হচ্ছে না জাপানের পরিচয়

-


পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নির্বাচন নিয়ে স্বাভাবিক যে উত্তেজনা বা উন্মাদনা থাকে জাপানের ক্ষেত্রে সেটি একেবারেই অনুপস্থিত। গোলযোগ থেকে শত মাইল দূরে অবস্থান করা এ দেশটিতে নির্বাচন বা নির্বাচনকেন্দ্রিক উত্তেজনা কোনোটিই স্পর্শ করতে পারে না সাধারণ লোকজনকে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার এ অংশে নির্বাচন হলে টের পায় পুরো বিশ্ব; আবার নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের মতো দেশগুলোর রাজনৈতিক সঙ্কটও জড়িয়ে ফেলে বিশ্বের অনেক দেশকে। জাপানের অবস্থানটা এক্ষেত্রে অনেকটাই ভিন্নতর।
তবে এতটা ভিন্নতা বা নিস্পৃহতার মধ্যেও দেশটির জনগণ কিন্তু সরকারকে তাদের পরিচয় পাল্টে ফেলার ক্ষমতা থেকে দূরেই রেখে দিয়েছে। যা ইচ্ছে তা-ই করে ফেলার অনুমতি দিয়ে দেয়নি।
শিনজো অ্যাবের সরকার সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে জাপানের অবস্থান পাল্টে ফেলতে চাইছে। কিন্তু এ পরিবর্তনের জন্য দরকার ছিল পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন। দেশটির পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষে এটি পেয়ে গেলেও কাক্সিক্ষত সমর্থনের অভাবে সে সুযোগ এবারেও পাচ্ছে না অ্যাবের সরকার।
পেছন ফিরে দেখা
জাপানিরা খুবই শান্তিপ্রিয় এবং অমায়িক চরিত্রের অধিকারী বলেই সবার জানা। কিন্তু এই মানসিকতা তারা হাজার বছর ধরে লালন করে আসেনি। বলতে গেলে, তাদের এ পরিবর্তন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হয়েছে বিস্ময়করভাবে। সে কারণে আজকের জাপানকে দেখলে মনেই হয় না যে, এরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল সবচেয়ে মারাত্মক, দক্ষ ও বর্বর বাহিনীগুলোর একটি। জাপানি সেনাবাহিনীর সহিংসতার চিত্র দেখা গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরো সময়জুড়েই। এ বাহিনীই পার্ল হারবারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এ হামলার মাধ্যমে মিত্রপক্ষে যোগদানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে আসে তারা। তখনকার জাপানি সামরিক বাহিনীর নাম ছিল ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ মিলিটারি’। জাপানের সম্রাট হিরোহিতোই মূলত জাপানকে একটি শক্তিশালী মিলিটারি শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি নিজ দেশ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ক্ষমতা বিস্তারের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে আসছিল। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গিয়েছিল।
শান্তিবাদের পথে জাপান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা অন্যদের মতো জাপানিদেরকেও দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে পারমাণবিক বোমায় আক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে দীর্ঘস্থায়ীভাবে দেশটির জনগণ শান্তিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এরপর সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক বিবাদ মেটাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা কার্যকর হয় ১৯৪৭ সালের ৩ মে। এ সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র হিসেবে জাপানের যুদ্ধে যোগদানের অধিকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করে ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখার কথা বলা হয়। আরো বলা হয়, যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে কোনো সেনাবাহিনী গঠন করা যাবে না। বরং এর বদলে আত্মরক্ষাবাহিনী রেখে আসছে দেশটি। তখন থেকেই জাপানের সংবিধান পরিচিতি লাভ করে ‘শান্তিবাদী সংবিধান’ নামে। ১৯৫১ সালে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সই হয়েছিল ‘সানফ্রান্সিস্কো শান্তি চুক্তি’। সেখানে বলা হয়, যেকোনো ধরনের বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে জাপান এবং জাপানের মানুষকে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র। এর বদলে তারা জাপান এবং পূর্ব-এশিয়ায় শান্তি রক্ষার্থে জাপানে নৌ ও সেনাবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে জাপানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
আধুনিকতার দিকে
১৯৪৭-এর সংবিধানে জাপানের যুদ্ধে অংশ নেয়ার অধিকারকে অস্বীকার করার পাশাপাশি জাপানের কোনো সামরিক ক্ষমতা না রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫০-এর কোরিয়া যুদ্ধের সময়ে জাপানে পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের নিকটবর্তী হওয়ায় ভৌগোলিক কৌশলগত কারণে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব মৌলিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর কথা ভাবতে হয় দেশটিকে। ১৯৫৪ সালে সেই বাহিনী থেকেই জাপানি সেনা গঠন করা হয়, যা জাপান সেলফ ডিফেন্স ফোর্সেস (এসডিএফ) নামে পরিচিত। যদিও এদের ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরে উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয় এবং যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক সামরিক সংযুক্তি থেকে তাদের দূরে রাখা হয়। ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিনজো অ্যাবে দেশটির ক্ষমতায় আসার পরপরই তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা দেশটির সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত স্ব-আরোপিত এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে একটি প্রস্তাব পাস করেন, যার মাধ্যমে দেশটির সেনাবাহিনী সমষ্টিগত আত্মরক্ষার অধিকার চর্চা বা আক্রান্ত কোনো বন্ধুভাবাপন্ন দেশকে সামরিক সহায়তা দেয়ার সুযোগ ফিরে পায়। ২০১৪ সালে নিজেদের সামরিক নীতিতে বড়সড় পরিবর্তন আনে জাপান। তাতে ওই শান্তিবাদী পথ থেকে ফিরে আসে। বলা হয়, অন্য দেশকে সাহায্যের জন্যও জাপান সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। ঘরে বাইরে প্রবল আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এ প্রস্তাব পাস হয়েছিল ২০১৪ সালের ১ জুলাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণের পরে মার্কিন মধ্যস্থতায় জাপানের যে নতুন সংবিধান রচিত হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, যেকোনো সমস্যায় আমেরিকা জাপানের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু ৬৭ বছর পর এসে নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে চায় জাপান।
পুরো হলো না অ্যাবের আশা
২০১৫ সালে জাপানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ দেশের নিরাপত্তা আইনে পরিবর্তনসংক্রান্ত দু’টি বিল অনুমোদন করে। এগুলো চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হলে জাপানি সেনারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার বিদেশে গিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিতে পারবে। জাপানের সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইলে কোনো দল বা জোটের দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া জরুরি। কিন্তু সদ্য অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে এলডিপি জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভে ব্যর্থ হওয়ায় এ সরকারের আমলে আর সংবিধান পরিবর্তন করতে পারছে না সরকার। নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে আবের ক্ষমতাসীন জোটের প্রয়োজন ছিল ৮৫টি আসন আর তারা জয় পেয়েছে ৬৯টি আসনে। যদিও নিম্নকক্ষে অ্যাবের দল এলডিপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তবুও সংবিধান সংশোধনের জন্য উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হয়।
শিনজো অ্যাবের আশা ছিল, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে জাপানি সেনাবাহিনীর ভূমিকায় পরিবর্তন এনে সামরিক কার্যক্রম আরো সম্প্রসারণ করা হবে। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হলে সহজেই তিনি এটি বাস্তবায়ন করতে পারতেন। আর সে কারণেই অন্তত এবারের নির্বাচনটি জাপানের শাসক দল এবং তার পাশাপাশি চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় আপাত কোনো পরিবর্তন আসছে না জাপানের সংবিধানে। এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে জাপানের প্রতিবেশীরা।
আবারো পরাক্রমশক্তি জাপান?
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর যে বাহিনী নিয়ে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ করেছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্রই জাপানকে তার চেয়ে কয়েকগুণ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী তৈরি করে নিতে সাহায্য করেছে। এ বাহিনী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি জাপানের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্রের বাহিনীর সাথে একসাথে কাজ করতে পারবে। যদিও এ ব্যাখ্যা দেশটির সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক।
আর হাজারো বেড়াজাল থাকলেও ইতোমধ্যেই জাপান গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেদের ঘর। উচ্চাভিলাষী আধুনিকায়ন পরিকল্পনাসহ জাপানের রয়েছে সুসজ্জিত বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনী। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবশালী সেনা শক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে দেশটি তার নিজস্ব সেনাবাহিনীরও আধুনিকায়ন করেছে। ফলে পার্লামেন্টের অনুমোদন পেলে অ্যাবে যে এ অঞ্চলে আরেকটা পরাশক্তি গড়ে তুলবেন না, এ কথার নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছে না কেউই। হ


আরো সংবাদ



premium cement
বান্দরবানে বৃষ্টির চেয়ে চোখের পানি ফেলে বিশেষ নামাজ চকরিয়ায় যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৭ উপজেলা নির্বাচনে ব্যর্থ হলে গণতন্ত্র ক্ষুণ্ন হবে: সিইসি বাগাতিপাড়ায় ইসতিসকার নামাজ পরিবর্তনশীল জলবায়ুর জন্য কাসাভা উপযুক্ত, হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৫-৫০ টন : বাকৃবি অধ্যাপক বৃষ্টির জন্য হাকাকার, সাভারে ইসতিসকার নামাজ আদায় বরিশালে সালাতুল ইসতিসকার আদায় অর্ধ শতাব্দীতে ভ্যাকসিন সাড়ে ১৫ কোটি লোকের জীবন বাঁচিয়েছে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আল্লাহর রহমত কামনায় সকলকে সিজদাহ অবনত হতে হবে-মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন কাউখালীতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা ভাঙ্গায় বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

সকল