১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুতিনের দেহরক্ষী বাহিনীর ইতিবৃত্ত

-

বিশ্বজুড়ে অস্ত্র, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতায় রাশিয়া যেমন অনন্য হয়ে উঠেছে; তেমনি অনন্য হয়ে উঠেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। আর এই পুতিনের নিরাপত্তায় রয়েছে বিশাল একটি বাহিনী। এত বড় একটি শক্তিশালী দেশের নেতার জন্য যেমন নিরাপত্তা বাহিনী দরকার, পুতিনের নিরাপত্তায় থাকা ফেডারেল প্রটেকটিভ সার্ভিস বা এসএফও-ও ঠিক তা-ই।
মূলত বিভিন্ন সময় রাশিয়ায় পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা যায়, পুতিনের জনসমর্থন ৮০ শতাংশের ওপরে। সে হিসেবে তার উদ্বিগ্নবোধ করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু তারপরও পুতিন নিজ নিরাপত্তা নিয়ে বেশ গভীরভাবেই উদ্বিগ্ন। এ কারণে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে রাশিয়ান ন্যাশনাল গার্ড নামে একটি অভ্যন্তরীণ বাহিনী গঠন করেন তিনি। এর সৈন্যসংখ্যা সাড়ে তিন লাখ এবং এ বাহিনী কেবল পুতিনের প্রতি অনুগত। এই বাহিনীর নেতৃত্ব যে জেনারেলের হাতে, তিনি বহু বছর ধরে পুতিনের বিশেষ দেহরক্ষী ছিলেন। নিজের সৈন্যদের কোথাও নিয়োজিত করতে চাইলে এই জেনারেলের পুতিন ছাড়া অন্য আর কারোর অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন নেই, বাধ্যবাধকতাও নেই। এ জেনারেল ও তার বাহিনী এক স্বাধীন সত্তা হিসেবে কাজ করে। পুতিনের এমন এক শক্তিশালী রক্ষীবাহিনী তৈরির প্রয়োজনের কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, জনমত জরিপের ফল যাই হোক না কেন, নিজের জনগণকে নিয়ে পুতিনের এক সুগভীর ভীতি রয়েছে। এ ধরনের গণ-অভ্যুত্থানের আশঙ্কা তার আত্মজৈবনিক কাহিনীতেও আছে।
১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে পুতিন ড্রেসডেনে কেজিবির অফিসার ছিলেন। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর ক্রুদ্ধ জার্মানদের এক দল উচ্ছৃঙ্খল জনতা তার সদর দফতরে হামলা চালায়। সরকারি কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলার মরিয়া চেষ্টা চালানোর সময় পুতিন মস্কোর নির্দেশের জন্য টেলিফোন করেছিলেন। কেউ তার টেলিফোনে সাড়া দেয়নি। তখনই তিনি ঠিক করেছিলেন, কখনোই আর অন্য কারো ওপর নির্ভর করে থাকবেন না। তৈরি করবেন একান্ত নিজস্ব একটি বাহিনী। তবে যেহেতু একেবারে তার কাছে চলে যেতে পারে, তাই এ বাহিনীর সদস্যদের বিশুদ্ধতা হতে হয় প্রশ্নাতীত। সেভাবেই রিক্রুট করা হয় তাদের। কিন্তু এ বাহিনীর বিশ্বস্ততা, আনুগত্য ধরে রাখতে পুতিন আরেকটি কাজ করে থাকেন। তা হচ্ছে, এ নিরাপত্তা বাহিনীর নেতৃত্বে যারা থাকেন, পুতিন এক সময় আরো গুরুত্বপূর্ণ, লাভজনক ও প্রভাবশালী কিছু পদে তাদেরকে পদায়ন করে থাকেন। এমনিতেই এ পর্যায়ের ব্যক্তিরা নিরাপত্তার খাতিরে ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখেন। কিন্তু পুতিন এ ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে। তিনি ওই পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন। ফলে শুধু তার নিরাপত্তা দেয়াকালীনই নয়, আজীবনের জন্য তাদের বিশ্বস্ততা পেয়ে যান পুতিন।
যেমন ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ বাহিনীর চারজন পদোন্নতি পেয়েছেন আঞ্চলিক গভর্নর হিসেবে। পঞ্চম আরেকজনকে নতুন গঠিত ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান বানিয়ে দেয়া হয়। এ বাহিনীরই আরেকজনকে পদায়ন করা হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। যেখানে তিনি বিশেষ বাহিনীকে পরিচালনা করতেন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া অপারেশন পরিচালিত হয় তার নির্দেশনাতেই। ২০১৬ সালে অ্যালেক্সে দায়ুমিন নামের ওই ব্যক্তিকে রাশিয়ার অস্ত্রসমৃদ্ধ এলাকা ‘তুলা’র গভর্নর বানিয়ে দেয়া হয়। পুতিনের এসব পদায়নকে অনেকেই ‘বাটলার থেকে হঠাৎ ডিউক হয়ে যাওয়া’ বলে সমালোচনা করে থাকেন।
অবশ্য এসব সমালোচনাতে তেমন কোনো কিছুই আসে যায় না পুতিনের, বরং পুতিনের দেয়া এসব সুযোগ-সুবিধা তথা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা থাকায় এ বাহিনীর আনুগত্য, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি হয় আরো নিñিদ্র। পুতিন পান আরো উদ্যমী, কর্মঠ একটি নিরাপত্তা বাহিনী। এ দলের সদস্যরা পুতিন বাইরে থাকার সময় তার নিরাপত্তা সহযোগী। আর যখন নিজ বাসভবনে থাকেন তখন এরা পুতিনের রান্নাঘরও সামলায়। অর্থাৎ বিশ্বস্ততা আর নৈকট্যের অপূর্ব সমন্বয় রেখেই চলেন পুতিন।
পুতিন তার এ বাহিনীকে ঠিক যুগের সাথে তাল মিলিয়েই পরিচালনা করছেন। তাই ওই রক্ষীবাহিনী যেখানে হামলা-সংঘর্ষ থেকে পুতিনকে রক্ষা করে থাকে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ জনমত জরিপ, রাজনৈতিক বিশ্লেষণসহ এ ধারার অনেক কাজই বর্তমানে এ বাহিনীর দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এরা বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ও সরকারি অন্যান্য সংস্থাকে গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করে থাকে। গত বছরই তিনি এ দলটিকে বর্তমানের ভার্চুয়াল যুদ্ধে লড়াইয়ের উপযোগী করে গড়ে তোলেন। পুতিন এ বাহিনীকে এতটাই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন; এমনকি তিনি তার সর্বশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পলিসি বাস্তবায়ন কর্মসূচির একটি বিরাট অংশ তাদের হাতে সমর্পণ করেন।
এ প্রতিরোধ বাহিনী বা রক্ষীবাহিনীর অবস্থান রাশিয়ায় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অবশ্য নতুন নয়। ১৮৮১ সালের ইতিহাসেও এই এফএসও বাহিনীর দেখা মেলে। এটি সেই সময়ের কথা, যখন আততায়ীর হাতে বাবার মৃত্যুর পর জার তৃতীয় আলেক্সাজান্ডার বিশেষ গার্ড বা রক্ষীবাহিনী তৈরি করেন। কেজিবির একজন সাবেক জেনারেল গেন্যাডি গুডকভ বলেন, এ বাহিনীটি সব সময় শাসকবর্গকে জনগণ থেকে নিরাপত্তার আবরণে ঢেকে রাখত। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম দিকে নিকোলাই ভøামিক নামে স্ট্যালিনের একজন দেহরক্ষী ছিলেন, যিনি রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো লেখালেখি থেকে শুরু করে তার সন্তানের দেখাশোনা পর্যন্ত করতেন।
পরে এ সংস্থা কেজিবির সাথে একীভূত হয়ে নতুন আরেকটি শাখায় পরিণত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে বরিস ইয়েলেৎসিনের দেহরক্ষী আলেক্সান্ডার কেজিকভ ওই ধ্বংসাবশেষ থেকেই আরেকটি বাহিনী তৈরি করেন এবং তিনি হয়ে ওঠেন মস্কোর একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
অতঃপর যখন পুতিন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি তার পুরনো সহযোগী এভগেনি মুরোভকে এফএসও-এর প্রধান বানান। তার অধীনে এ বাহিনী দেশটির অভিজাত সম্প্রদায়ের ওপর নজর রাখতে শুরু করে। এ ছাড়া সুসংবদ্ধ অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধেও তারা সক্রিয় হয়। যদিও বলা হচ্ছে, ২০১৬ সালে মুরোভ এ সংস্থা থেকে সরে যাওয়ার পর এটি আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে, কিন্তু অনেকের দৃষ্টিতে সার্বিকভাবে এটি আগের মতোই শক্তিশালী রয়েছে। এমনকি এ কারণে অনেকেই এ বাহিনীর সাবেক সদস্য দায়ুমিনকে প্রেসিডেন্ট পুতিনের উত্তরসূরি হিসেবেই দেখতে পান।


আরো সংবাদ



premium cement