২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কোন পথে ইসরাইল-হামাস সঙ্ঘাত

-

মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল। ১৯৪৮ সালের পর থেকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে দেশটি একাই। দীর্ঘ এ সময়ে যারাই অবৈধভাবে সৃষ্ট এ দেশটির শাসনক্ষমতায় এসেছে, তারা সবাই ফিলিস্তিন প্রশ্নে ছিলেন নৃশংস মানসিকতার অধিকারী। যাদের হাত ধরে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটির জন্ম সেই প্রভু দেশগুলোর দেয়া দায়িত্ব পালনার্থেই যেন বিভিন্ন সময় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাথে বারবার কঠিন সঙ্ঘাতে জড়িয়েছে ইসরাইল। ফলে ইসরাইল এখন সবার কাছে মধ্যপ্রাচ্যের মূর্তিমান এক আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত।
মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সেখানে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশ ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা মনে করত, এর দ্বারা আরব বিশ্বের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যাবে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ডেভিড বেনগুরিয়ান ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। একই সাথে তিনি নিজেকে ইসরাইল নামক একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। অথচ সে দিন এই রাষ্ট্রটির কোনো সীমানা ছিল না, ছিল না কোনো পূর্ণাঙ্গ সরকার, ছিল না কোনো ভূখণ্ড এবং ছিল না কোনো সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী। অথচ স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো শক্তিশালী দেশসহ ৩৩টি দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৬ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল মিসরের সিনাই এলাকা দখল করে। ১৯৬৭ সালে তারা দখল করে নেয় পূর্ব জেরুসালেম। একই বছর তারা দখল করে নেয় সিরিয়ার গোলান মালভূমিও। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের আইল ঠেলার মতো করে ফিলিস্তিনের জায়গা দখল করে নিজেদের পরিধি বাড়ানোর অপচেষ্টা তো আছেই। ইসরাইলকে সমর্থন দেয়া রাষ্ট্রগুলো নির্বিচারে তেলআবিবকে সমর্থন দিয়ে এলেও ইসরাইলের এসব দখলের ব্যাপারে তারা ভিন্ন ভূমিকা পালন করত। সব সময়ই তেলআবিবের এসব দখলকে অবৈধ বলেই উল্লেখ করত দেশগুলো।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর যেন হাতে আলাদিনের চেরাগ লাভ করে ইসরাইল। আগের চেয়ে তারা অনেক বেশি অন্ধ সমর্থন পেতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন ট্রাম্প। যে ইস্যুটিকে মার্কিন শাসকবর্গ দশকের পর দশক ধরে ‘নীরবতার কৌশলে’ পার করে এসেছিলেন অবলীলায়-অনায়াসে, ট্রাম্প দিয়ে দেন সেই স্বীকৃতি। একই সাথে মার্কিন দূতাবাসও তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে আনার ঘোষণা যেন ইসরাইলকে যা ইচ্ছা খুশি করার অনুমতি দিয়ে দেয়। এরপর এ বছরের ২৬ মার্চ ট্রাম্প ঘোষণা দেন গোলান মালভূমি ইসরাইলেরই অংশ। একের পর এক এমন মার্কিন স্বীকৃতি শক্তিগর্বে মদমত্ত ইসরাইলকে অনেক বেশি আগ্রাসী করে তোলে।
মার্কিন প্রতিটি এমন ঘোষণার পরপরই ফিলিস্তিন বিশেষ করে গাজাবাসীর ওপর অনেকবেশি খড়গহস্ত হয়ে ওঠে ইসরাইল। ২০১৮ সালে জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে আনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরই অনেক বেশি নির্মমতা প্রদর্শন করে তেলআবিব। সে বছরের ৩০ মার্চ ভূমি দিবস উপলক্ষে ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’ নামে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত চলে দখলদার বাহিনীর হামলা। তাদের এ হামলায় দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২০ সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি। এ বছরের মার্চ মাসে গোলান নিয়ে মার্কিন ঘোষণার পর মে মাসে এসে আবারো সঙ্ঘাতে জড়ায় ইসরাইল। এ মাসের শুরুতে ইসরাইলি বাহিনীর সে রকেট আর বোমাবর্ষণে নিহত হয় ২৭ ফিলিস্তিনি। তাদের মধ্যে প্রতিরোধ যোদ্ধা যেমন ছিল, তেমনি ছিল সাধারণ নিরীহ মানুষও। বসে থাকেনি ফিলিস্তিনিরাও। তারাও পাল্টা হামলা চালায়। তাদের হামলায় মারা যায় চারজন সাধারণ ইসরাইলি নাগরিক। অন্যবারের মতোই এই লড়াইয়ের সমাপ্তি তথা যুদ্ধবিরতি ঘটে মিসর, কাতার ও জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায়। তবে মূল বিষয়টি হচ্ছে, কেউই আশা করছে না যে, এ যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে।
সাম্প্রতিক লড়াইয়ের সময় গাজা থেকে ইসরাইলে সাত শতাধিক রকেট ছুড়েছে প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও ইসলামিক জিহাদ। এতে চার ইসরাইলি নাগরিক নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম দৈনিক হারেৎজের খবরে বলা হয়েছে, গাজা থেকে ইসরাইলে ৬৯০টি রকেট ছোড়া হয়েছে। কিন্তু ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোম তার মধ্যে মাত্র ২৪০টি ভূপাতিত করতে পেরেছে। এ ঘটনাকে নিজেদের বিজয় হিসেবে দাবি করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ইসরাইলের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে বেশ বড় করেই দেখা হচ্ছে। কারণ ২০১৮ সালের পুরোটা জুড়েই হামাস ইসরাইলের প্রায় এক হাজার রকেট ছুড়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ দু-তিন দিনের লড়াইয়েই তারা সাত শতাধিক রকেট হামলা চালায়। এ দিকে ইসরাইল যেসব ভবনে হামলা চালায়, তারা দাবি করছে সেখান থেকে হামাস সদস্যরা সাইবার হামলা চালাত। দুটি বিষয়ই ইসরাইলের জন্য বেশ উদ্বেগজনক। একপর্যায়ে অস্ত্রবিরতিতে পৌঁছেছে হামাস ও ইসরাইল।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরাইল ও হামাস আসলে একটি বৃত্তে বন্দী হয়ে গেছে। কারণ ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আর যাই করুন না কেন, হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে কোনো আক্রমণ চালাতে চান না। এর নেপথ্য কারণ হচ্ছে, তিনি নিশ্চিত নন যে, হামাসকে সরিয়ে দিলে তার জায়গা কারা দখল নেবে। অন্য দিকে, গাজা বা ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেকেই নেতানিয়াহুকে পছন্দ করেন না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ পর্যায়ে নেতানিয়াহুর কোনো বিকল্পও নেই। এ কারণে আবারো ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর পদটি দখল করেছেন নেতানিয়াহু। ফলাফল দাঁড়াচ্ছে ফিলিস্তিনে যেমন হামাস থেকেই যাচ্ছে, তেমনি ইসরাইলেও যথারীতি থাকছেন নেতানিয়াহু। একই সাথে দুই পক্ষের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা-ও অব্যাহত থাকছে আগের মতোই।
বিশ্লেষকদের মতে, হামাস বিশ্বাস করে, টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো অস্ত্র হচ্ছে শক্তি প্রয়োগ করা। কারণ সাম্প্রতিক সঙ্ঘাতের পর তারা এর ফল পেয়েছে। ইসরাইল তাদের মাছ ধরার সীমা ছয় মাইল থেকে বাড়িয়ে ১৫ মাইল করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি হামাস যেন সরকারি কর্মীদের বেতন দিতে পারে সে জন্য কাতারের সাহায্য ঢোকার ব্যাপারেও নিজেদের সম্মতি জানিয়েছে ইসরাইল। এ ছাড়া কাতার আরো ৪৮০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
হামাসের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরাইল এক সপ্তাহের মধ্যে আমদানি নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা সহজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তেলআবিবে ইউরোভিশন সঙ্গীত প্রতিযোগিতার শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এটি কার্যকর হওয়ার কথা। কারণ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিশ্চয়ই চাইবেন না, বিশ্বের লাখ লাখ লোক যখন টেলিভিশনে এই অনুষ্ঠান দেখবেন, তখন হামাসের সাথে তাদের সঙ্ঘাত চলতে থাকুক।
তবে ইসরাইলিদের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে ফিলিস্তিনিদের একটি অংশ তাদের কোনো ধরনের ছাড় ও প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেন না। তাদেরই একজন ইসলামিক জিহাদের প্রধান জিয়াদ আল নাখালেহ বলেছেন, সাম্প্রতিক সঙ্ঘাতটি ছিল আসন্ন যুদ্ধের একটি প্রকৃত প্রস্তুতি। যদি তা-ই হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই এ যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
তবে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে ফিলিস্তিনিদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে। আর কত রক্ত ঝরলে, লাশের মিছিল কতটা দীর্ঘ হলে তাদের ভূখণ্ড স্বপ্নের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ধরা দেবেÑ তা এখনো অজানা।হ


আরো সংবাদ



premium cement