২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আলজেরিয়ার পর সুদানেও স্বৈরশাসকের পতন

-

কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আফ্রিকার জনগণ ফুঁসে উঠেছে। জনগণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে দীর্ঘ দিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা স্বৈরশাসকদের দিন মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
জনগণ জরুরি অবস্থা, কারফিউ ও সামরিক শাসনকেও পাত্তা দিচ্ছে না। বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনের দাবিতে জনগণের বৃহত্তর ঐক্য স্বৈরশাসক ও সামরিক একনায়কদের ক্ষমতার মসনদকে খান খান করে দিচ্ছে।
তিন দশক সুদান শাসনের পর ১১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পতন হয়েছে স্বৈরশাসক ওমর আল বশিরের সরকারের। এর এক সপ্তাহ আগে আলজেরিয়ার একনায়ক আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকার শাসনের অবসান ঘটেছে। তিনিও দুই দশক ক্ষমতায় ছিলেন। আন্দোলনের মুখে বুতেফ্লিকা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আর বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে আটক করে সুদানের সেনাবাহিনী। তবে শুধু গণবিক্ষোভ নয়, সামরিক বাহিনীও দুই স্বৈরশাসকের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দুই কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রনায়কের দ্রুত পতনের পর দেশ দু’টিতে কি জনগণের দাবি অনুযায়ী বেসামরিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে?
ওমর আল বশির ১৯৮৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। তিন দশক পর আরেক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। টেলিভিশনে এক ঘোষণায় সুদানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আওয়াদ ইবনে অউফ নিশ্চিত করেন, আল বশিরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, ওমর আল বশিরকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং একটি নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। আল বশির যখন ক্ষমতা দখল করেন, সুদান তখন উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং এই গৃহযুদ্ধ দীর্ঘ ২১ বছর ধরে অব্যাহত ছিল। আল বশির শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করেছেন। ২০১১ সালে বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ সুদানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত এ দেশটি আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ ছিল।
বশিরের জন্ম ১৯৪৪ সালে উত্তর সুদানের একটি খামারি পরিবারে। তখন ওই এলাকাটি ছিল মিসরের রাজতন্ত্রের আওতাধীন। তিনি বেদুইন গোত্রের সদস্য ছিলেন। বশির তরুণ বয়সে মিসরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর অফিসার পদে পদোন্নতি পান। তার কোনো সন্তান নেই এবং ৫০ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। ক্ষমতা গ্রহণের আগে বশির সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলেন। গৃহযুদ্ধের সময় বিদ্রোহী নেতা জন গ্যারাঙ্গের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি সুদানিজ পিপলস লিবারেশন মুভমেন্টের পক্ষে গ্যারাঙ্গের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। তিনি সব সময় একটি ঐক্যবদ্ধ সুদানের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে দক্ষিণ সুদানের ব্যাপারে একসময় তিনি গণভোটের আয়োজন করতে বাধ্য হন। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত গণভোটে দক্ষিণ সুদানের ৯৯ শতাংশ ভোটার পৃথক একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পক্ষে ভোট দেয়। ছয় মাস পর স্বাধীন দক্ষিণ সুদান নামে পৃথক একটি রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়।
বশির যখন দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পক্ষে সম্মত হন, দারফুরের প্রতি তখনো তার মনোভাব ছিল আগ্রাসী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, দারফুরে বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা, লুটতরাজ ইত্যাদির অভিযোগ আনে। তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার বিরুদ্ধে ২০০৯ ও ২০১০ সালে দু’টি আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেই তিনি ২০১০ ও ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত দু’টি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। অবশ্য তার সর্বশেষ নির্বাচন বিরোধীরা বর্জন করেছিল।
সরকার তেল ও রুটির দাম বাড়ানোর পর গত ডিসেম্বরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তীকালে এই বিক্ষোভ সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে পরিণত হয়। কয়েক বছর ধরে সুদান অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর এই সঙ্কট বাড়তে থাকে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছেÑ দেশটির উত্তোলিত তেলের চার ভাগের তিন ভাগই রয়েছে দক্ষিণ সুদানে। মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় এবং জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ১৯ ডিসেম্বর রুটির দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে প্রধান শহরগুলোতে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ২০ ডিসেম্বর সরকার উৎখাতের ডাক দিয়ে খার্তুমসহ বড় শহরগুলোতে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত হয়। ২৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট বশির নীরবতা ভেঙে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। জানুয়ারি মাসে বছরের শুরুতে ২২ রাজনৈতিক সংগঠন নতুন সরকার গঠনের দাবি জানায়। ৯ জানুয়ারি খার্তুমে সরকারের সমর্থক ও বিরোধী পক্ষ পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করে। ১৭ জানুয়ারি পশ্চিমা দেশগুলো বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। এরপর বশির দলের উপনেতার হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর এবং বিক্ষোভের মধ্যেই নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। এরপর কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক ও ২২ ফেব্রুয়ারি এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকায় ৪ এপ্রিল বশির জনগণের উদ্বেগের কথা স্বীকার করে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। ৬ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করে। ১১ এপ্রিল বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে আটক করে সেনাবাহিনী। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশ পরিচালনায় সামরিক কাউন্সিল গঠন এবং ওই কাউন্সিল দুই বছর ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়েছিল। এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির প্রতি ওই কাউন্সিলে বেসামরিক প্রতিনিধি রাখার আহ্বান জানায়। ওই সামরিক কাউন্সিলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আওয়াদ ইবনে অউফ। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা বশিরের বিদায়ের পর সামরিক শাসন নয়, বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায় এবং কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করার পর সামরিক কাউন্সিলের প্রধান আওয়াদ ইবনে অউফ ক্ষমতা গ্রহণের এক দিন পর পদত্যাগ করেন। তিনি সামরিক বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আবদেল রাহমান বুরহানকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। অন্তর্বর্তীকালীন নেতার পদত্যাগের পর সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা ক্ষমতায় থাকতে চায় না এবং সুদানের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে আন্দোলনকারীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। সামরিক কাউন্সিলের নতুন প্রধান আল বুরহান বিক্ষোভকারীদের সাথে আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, বশিরের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় অন্তত ৩৮ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। এ দিকে বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও রাজধানী খার্তুমের সড়কে থাকতে সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিক্ষোভকারী নেতারা। সুদানের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে সুদানিজ প্রফেশনালস অ্যাসোসিয়েশন (এসপিএ)। এক বিবৃতিতে এসপিএ বলেছে, বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত থাকবে।
সুদানের জনগণের দাবি অনুযায়ী, দেশটিতে কি এখন গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হবে? বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থিত অলাভজনক সংগঠনের অতিথি বিশেষজ্ঞ মার্ক পিয়েরিনির মতে, ‘আলজেরিয়া আর সুদানের প্রেক্ষাপটের মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে দেশ দুটোর ঘটনা থেকে স্বৈরশাসক ও একনায়কদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হলোÑ ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র আর সবার জন্য সমান সুযোগের ক্ষুধা সার্বজনীন।’ তিউনিসিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া, মরক্কো ও তুরস্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, উভয় দেশের ক্ষেত্রেই ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ ও অর্থ পকেটে পুরেছেন। অনেকেই বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় বুতেফ্লিকা ও বশির ছাড়া আরো কয়েকজন একনায়ক রয়েছেন। মরক্কো রাজপ্রথায় পরিচালিত। আর মিসর চলছে সাবেক সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির নেতৃত্বে। মোহাম্মদ মুরসির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন সিসি।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সেন্টার ফর মিডল ইস্ট পলিসির পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো শরন গ্রেওয়াল বলেন, আলজেরিয়া ও সুদানের ঘটনা ২০১০-১১ সালের আরব বসন্তের পুনরুত্থান ঘটাবে কি না, তা ধারণা করা কঠিন। ওই বিক্ষোভ মিসর ও তিউনিসিয়ায় শাসকশ্রেণীর পতন ঘটিয়েছে, সিরিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছে। জীবনমানের উন্নয়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আলজেরিয়া ও সুদানে যে বিক্ষোভ তার ওপর এই অঞ্চলের অন্যান্য একনায়কেরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন বলেও দাবি করেন শরন গ্রেওয়াল।
ওমর আল বশিরের দীর্ঘ শাসনামলের একপর্যায়ে ইসলামপন্থী নেতা হাসান আল তুরাবির প্রভাবও তার ওপর পড়েছিল। পরে অবশ্য দু’জনের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। ওমর একসময় বেসামরিক বা সিভিল রাইটসকে ছুড়ে ফেলেন। খ্রিষ্টানদের শান্তিতে থাকতে দেননি। মুক্তচিন্তা ও সমালোচকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসেন। দেশকে একসময় বর্বর ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের নিগড়ে আবদ্ধ করেন। শেষ পর্যন্ত এর পরিণতিই তাকে ভোগ করতে হলো। এখন দেশটি গণতন্ত্রের পথেই হাঁটবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুদান বা আলজেরিয়াতেই পরিবর্তন সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই বসন্তে আরেক একনায়ক কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট নুর সুলতান নাজারবায়েভও ক্ষমতা ছেড়েছেন। সুদান ও আলজেরিয়ার স্বৈরশাসকদের পতনের পর সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কি না তা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। হ


আরো সংবাদ



premium cement