২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গোলান মালভূমি ও পশ্চিমতীরের নিয়ন্ত্রণ

-

হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর টানা পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠনের রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ৯ এপ্রিল দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও আরো কয়েকটি ডানপন্থী দলকে নিয়ে জোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন তিনি। যদিও এর আগে পাল্টাপাল্টি জয়ের দাবি করে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জোট। তবে ইসরাইলের ভোট গ্রহণকে শুধু নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে আগেই আখ্যা দিয়েছে ফিলিস্তিন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ও গোলান মালভূমির স্বীকৃতি আদায়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন এবং ইসরাইলিদের নিরাপত্তা ইস্যুকে নির্বাচনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন নেতানিয়াহু।
অন্য দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বেনি গান্তজ নেতানিয়াহুর দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সঙ্কট সমাধান নিয়ে কোনো কথা বলেননি। আর তাই যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন? তাতে সঙ্কট উত্তরণের পথ দেখছে না ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনের প্রধান আলোচক সোয়েব ইরাকাত বলেছেন, ইসরাইলের নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, বরং উদ্বিগ্ন। তাদের নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে ফিলিস্তিন ইস্যু অনুপস্থিত। নেতানিয়াহু তার নির্বাচনী বক্তব্যে শান্তির কথা না বলে অবৈধ দখলদারিত্বের কথা বলেছেন।
নির্বাচনের কিছু দিন আগে গোলান মালভূমির ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে এক ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইল এ জায়গাটি সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে নিয়েছিল। হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ওই ঘোষণায় স্বাক্ষর করছিলেনÑ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এটা এক বিরাট পরিবর্তন। কারণ এর আগে দশকের পর দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বে অন্য বহু দেশ ইসরাইল এই গোলান দখলদারিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ট্রাম্প এসে সেটিকে উল্টে দিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, ইসরাইলকে আক্রমণ করার জন্য ইরান ঘাঁটি হিসেবে সিরিয়াকে ব্যবহার করছে এবং গোলান হচ্ছে সেই প্রয়াসের ‘ফ্রন্ট লাইন’। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীও এটা এক গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। কারণ এ স্বীকৃতির মাধ্যমে ট্রাম্প কার্যত গোলানে ইসরাইলের দখলদারিত্বকেই অনুমোদন দিয়ে দিলেন।
উদ্বেগের বড় বিষয় হলো, ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার সমর্থকেরা আশঙ্কা করছেন, গোলানের ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি এখন পশ্চিমতীরকেও ইসরাইলের অংশে পরিণত করার পথ সুগম করতে পারে।
গোলান মালভূমি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? দক্ষিণ পশ্চিম সিরিয়ার একটি পাথুরে মালভূমি এই গোলান। জায়গাটা বেশি বড় নয়, কিন্তু এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। গোলান মালভূমি থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক শহর এবং দক্ষিণ সিরিয়ার একটি বড় অংশ স্পষ্ট দেখা যায়। সিরিয়ান সেনাবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য এটা এক আদর্শ জায়গা। পার্বত্য এলাকা বলে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর কোনো সম্ভাব্য আক্রমণের পথে এটা একটা চমৎকার প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে। তা ছাড়া এটি প্রাকৃতিক পানির উৎস। গোলান মালভূমি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে জর্দান নদীতে। এর এটি হচ্ছে ইসরাইলের পানি সরবরাহের এক-তৃতীয়াংশের উৎস। জায়গাটি উর্বর এবং এখানে ফল ও আঙুরের চাষ হয়, পশুপালন হয়।
১৯৬৭ সালে ইসরাইল জায়গাটি দখল করার পর এখানকার সিরিয়ান আরব বাসিন্দারা বেশির ভাগই পালিয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে সিরিয়া এটি পুনর্দখল করার চেষ্টা করেও পারেনি। ১৯৭৪ সালে ইসরাইল সিরিয়া এক যুদ্ধবিরতি হয়, আর ১৯৮১ সালে ইসরাইল গোলানকে নিজের অংশ করে নেয় একতরফাভাবে। তবে এটা কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি।
এখানে ৩০টিরও বেশি ইসরাইলি বসতি আছে, যাতে ২০ হাজার ইসরাইলি বাস করে। এ ছাড়াও এখানে বাস করে প্রায় ২০ হাজার সিরিয়ান দ্রুজ সম্প্রদায়ের লোক।
এ দিকে আবার নির্বাচিত হলে দখলকৃত পশ্চিমতীরে ইহুদি বসতি স্থাপন সম্প্রসারিত করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। আন্তর্জাতিক আইনে এমন বসতি স্থাপন অবৈধ। কিন্তু এ অভিযোগ মানতে নারাজ ইসরাইল।
পশ্চিমতীরে এরই মধ্যে প্রায় চার লাখ ইহুদি বসতি স্থাপন করেছে। এর বাইরে আরো দুই লাখ বসতি গড়েছে পূর্ব জেরুসালেমে। পশ্চিমতীরে এখনো প্রায় ২৫ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস আছে। ফিলিস্তিনিরা চায় দখলকৃত পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুসালেম ও গাজা উপত্যকায় একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু এখানে ইসরাইলের দখলদারিত্ব তাদের সে উদ্যোগে বাধা সৃষ্টি করছে। এসব এলাকায় ইসরাইলের ইহুদি বসতি স্থাপন ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কলহের সবচেয়ে বড় ইস্যুর অন্যতম।
নেতানিয়াহু ইহুদিবসতি সম্পর্কে যা বলেছেন, তা সম্ভাব্য মারাত্মক গণবিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। কারণ বহু বছর ধরে এই ইস্যুতেই শান্তি প্রক্রিয়া বারবার থমকে গেছে। নেতানিয়াহু যেসব দলের সাথে জোট বেঁধে সরকার গঠন করতে চাইছেন, তারা এই কথা শুনে বেশ খুশি। কিন্তু এটি ফিলিস্তিনিদের মারাত্মক বিক্ষুব্ধ করে তুলবে। আন্তর্জাতিকভাবেও নিন্দিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে গোলান মালভূমিকে ইসরাইলের বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, তা হয়তো নেতানিয়াহুকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। হ


আরো সংবাদ



premium cement