২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আলজেরিয়ার বিলম্বিত আরব বসন্ত কি সফল হবে?

-

আলজেরিয়ার স্বৈরশাসক বুতেফ্লিকা গণবিক্ষোভের মুখে অবশেষে বিদায় নিয়েছেন। ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর গত ২ এপ্রিল তিনি পদত্যাগ করেন। দেশটির উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান জেনারেল আহমদ গেইত সালাহ ৮২ বছর বয়সী আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকাকে দেশ পরিচালনায় অযোগ্য ও অবিলম্বে দায়িত্ব ত্যাগ করার দাবি জানানোর পর প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের ঘোষণা আসে। বুতেফ্লিকার পদত্যাগের পর দেশটির হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করে।
কিন্তু বুতেফ্লিকার পদত্যাগের পরও দেশটির জনগণ তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। এখন তাদের দাবি বুতেফ্লিকার মূল সহযোগীরা দায়িত্ব থেকে সরে যাক। বিশেষ করে আলজেরিয়ার ক্ষমতা কাঠামোর তিন শাখার শীর্ষ ব্যক্তিরা। প্রধানমন্ত্রী নুরুদ্দিন বাদায়ী, সাংবিধানিক পরিষদের প্রেসিডেন্ট তালেব বেল আজিজ এবং পার্লামেন্টের উ” চকক্ষের প্রেসিডেন্ট আবদেল কাদের বেন সালাহ। এখন কোন পথে যাবে আলজেরিয়া? জনগণের দাবি কি পূরণ হবে? দেশটিতে কি সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে?
আলজেরিয়ার রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা সব সময় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে অঘোষিতভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছে। এবারো সেনাসমর্থন প্রত্যাহারের পরই কেবল বুতেফ্লিকার পতন ঘটেছে। ১৯৯৯ সাল থেকে প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীই বুতেফ্লিকাকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল। সেনাবাহিনী তেলসমৃদ্ধ উত্তর আফ্রিকার চার কোটি ২০ লাখ লোকের এ দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে চায়। সেনাপ্রধান জেনারেল গেইত সালাহ জনগণের পক্ষে থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের সাথে উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকের পর জেনারেল সালাহ বলেন, ‘জনগণ তাদের দাবি আদায়ে সম্পূর্ণভাবে সফল ও সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাবো।’ সৌভাগ্যক্রমে ছয় সপ্তাহব্যাপী চলমান এই বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ এবং পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের কোনো সঙ্ঘাত হয়নি এবং কোনো প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেনি।
প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকার পদত্যাগ হলো আলজেরিয়ার জনগণের প্রাথমিক বিজয়। আলজেরিয়ানরা গেইত সালাহসহ বুতেফ্লিকার সহযোগীদের বিদায় চায়। আলজেরিয়ার জনগণ তাদের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন চায়। বুতেফ্লিকার বিদায়ের আগে তিনি যে নতুন সরকার নিয়োগ দিয়েছেন জনগণ দাবি জানিয়েছে তাদের অবশ্যই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন ছাড়া লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
আলজেরিয়ার নাগরিকদের ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যারা রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। প্রতিবাদকারীদের এখন অবশ্যই ক্ষমতার স্তম্ভে যারা রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে। আন্দোলনকারীরা সব বয়স, শ্রেণী অঞ্চল এবং ছাত্র, অধ্যাপক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারকসহ সব পেশার মানুষকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। হেভিওয়েট ন্যাশনাল মুজাহিদিন সংগঠন যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করে তারাও এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। কয়েকজন এমপি পদত্যাগ করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট গত মাসে আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। আলজেরিয়ার পুলিশ সদস্যরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ তাদের হেলমেট খুলে তাদের দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আবার কোনো কোনো পুলিশ সদস্য সরকারবিরোধী সেøাগানও দিয়েছেন।
অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতার কারণে আলজেরীয়রা নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এ চমৎকার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন। তারা প্রতিবাদ বিক্ষোভকে বেসামরিক, শান্তিপূর্ণ এবং পুলিশের সমর্থন পাওয়ার উপযোগী করে নেন। যাতে পুলিশরাও মিত্র হিসেবে তাদের নিরাপত্তা দান করেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভবিষ্যতে পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে বলা হলে সে ক্ষেত্রে এ সম্পর্কটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড অবশ্যই পরিহার করতে হবে। প্রতিবাদকারীদের প্রতি শুক্রবার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। ছেলেমেয়ে এবং সিনিয়রদের সাথে নিয়ে হাস্যরসাত্মকভাবে প্রতিবাদ জনাতে হবে।
একই সাথে আলজেরীয়দের তাদের আমলাতন্ত্রকে অকার্যকর করে দেয়া অব্যাহত রাখতে হবে। বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং সরকারি আমলারা তাদের দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানালে, তেল ও গ্যাস শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীরা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকলে এবং পুলিশ কর্মকর্তা ও সৈন্যরা নির্দেশ পালন না করলে বুতেফ্লিকার সহযোগীরাও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন।
আলজেরিয়ানরা নৈতিক প্রতিশ্রুতি থেকেই অহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সঙ্কটের সমাধান চায়। কারণ তারা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। অতীতে তীব্র সহিংস কর্মকাণ্ড ফলপ্রসূ প্রমাণ হয়নি। আলজেরীয় সরকার নিরস্ত্র বিক্ষোভকারী যারা তাদের পরিবার-পরিজনকে নিয়েও বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালালে সেটা হবে বর্বরতা। এতে তাদের বৈধতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। গণবিক্ষোভ যেহেতু ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে তাই সঙ্কট সমাধানের জন্য আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা প্রয়োজন। বিক্ষোভকারীরা বিক্ষোভের জন্য কোনো নেতৃত্ব চায় না। তারা ব্ল্যাকমেইলেরও মুখোমুখি অথবা কারারুদ্ধ হতে চায় না।
বিক্ষোভকারীরা আলজেরিয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিকে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে চায়। তারা চায় দ্রুত রাজনৈতিক সংস্কার। তারা বর্তমান নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র নয়Ñ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যেকোনো সামরিক প্রভাবমুক্ত যোগ্য ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায়। বর্তমানে সরকারি ব্লকের আওতায় সরকার পরিচালিত হচ্ছে। জনগণ তাদের কাছ থেকে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত নির্বাচন চায়।
আলজেরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের বর্তমান স্পিকার আবদুল কাদের বিন সালাহ অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। নিয়ম অনুযায়ী অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা বুতেফ্লিকার কোনো সহযোগীকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট বা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় থাকার ব্যাপারে মেনে নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত কী হতে যাচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে তিউনিশিয়ায়। এরপর তা মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন আলজেরিয়ায় তার তেমন একটা ছোঁয়া লাগেনি। আরব বসন্তের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। মিসরে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে রেখেছে। ইয়েমেনে সঙ্কটÑ সঙ্কট থেকে যুদ্ধ এবং সিরিয়ায় যুদ্ধের মাধ্যমে দেশটি বিপুল প্রাণহানি ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। লিবিয়ায়ও গৃহযুদ্ধ এবং অশান্তি বিদ্যমান। আলজেরিয়ার জনগণের আন্দোলনের জয় হোক, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটি সঠিক পথে এগিয়ে যাবেÑ এটাই পর্যবেক্ষক মহলের কামনা। হ


আরো সংবাদ



premium cement