২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গোলান নিয়ে ট্রাম্পের ঔদ্ধত্য!

-

বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমের নিজেদের সম্মান ও মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খোদ আমেরিকারই মারাত্মক ক্ষতি করেছেন। ট্রাম্পের সর্বশেষ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে তিনি গত ২৫ মার্চ হঠাৎ করে এক ঘোষণায় স্বাক্ষর করে বলেছেন, গোলান মালভূমি ইসরাইলের। সিরিয়ার গোলান মালভূমিকে ইসরাইলি ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ট্রাম্প ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঔদ্ধত্য যেকোনো পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তা বর্ণনাতীত। ট্রাম্পের ওই ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বীকৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ট্রাম্পের স্বীকৃতির পর জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ইস্যুতে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছে। সৌদি আরব, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কাতার এবং লেবানন ও ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছে। আরব নেতারাও মার্কিন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। আকস্মিকভাবে ট্রাম্পের এসব বিতর্কিত ও একতরফা সিদ্ধান্তের কারণ কী?
আমরা জানি, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইল-সিরীয় ভূখণ্ড গোলান মালভূমি দখল করে নিয়েছিল। তখন থেকে ওই জায়গাটি ইসরাইলের দখলে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এই দখলের স্বীকৃতি কোনো দেশই দেয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একমত যে, গোলান সিরিয়ায় ভূখণ্ড এবং ইসরাইলকে এই ভূখণ্ড ফেরত দিতে হবে। জাতিসঙ্ঘও এই মর্মে একাধিক প্রস্তাব পাস করেছে এবং নির্দেশ দিয়েছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত ২৫ মার্চ হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার উপস্থিতিতেই ট্রাম্প ওই ঘোষণায় স্বাক্ষর দেন। ওই সময় হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের জামাতা ও উপদেষ্টা ইহুদি ধর্মাবলম্বী জ্যারড কুশনার উপস্থিত ছিলেন।
গোলান মালভূমিকে হঠাৎ ইসরাইলি দখলদারিত্বের স্বীকৃতি দেয়ার কারণ কী? গোলান মালভূমি হচ্ছে সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি পাথুরে মালভূমি। জায়গাটি খুব বড় না হলেও এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। গোলান মালভূমি থেকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দূরত্ব মাত্র ৪০ মাইল। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য এটি একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। মালভূমিটি প্রাকৃতিক পানিরও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে সিরিয়া গোলান মালভূমি পুনর্দখল করার চেষ্টা করেও পারেনি। ১৯৮১ সালে ইসরাইল গোলানকে একতরফা নিজের অংশ করে নেয়।
গোলান মালভূমি নিয়ে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইতোমধ্যে একঘরে হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গোলানকে ইসরাইলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ঘোষণাপত্রে সই করেছেনÑ পরিষদের অবশিষ্ট ১৪টি সদস্য দেশ তার তীব্র বিরোধিতা ও সমালোচনা করেছে। সিরিয়া পরিষদের ওই বৈঠক ডাকার আহ্বান জানানোর পর বুধবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসঙ্ঘে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কারেন প্রিন্স বলেছেন, ১৯৮১ সালে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবের সাথে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত চরম লঙ্ঘন। পরিষদের বৈঠকে ইউরোপীয় দেশগুলো এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মার্কিন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে।
এদিকে গত ৩১ মার্চ তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে অনুষ্ঠিত আরব লিগের এক সম্মেলনে গোলান মালভূমিকে ইসরাইলি ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতির মার্কিন সিদ্ধান্তের সর্বসম্মতভাবে তীব্র নিন্দা করেছেন আরব নেতারা। এক সংবাদ সম্মেলনে আরব লিগের মহাসচিব আহমদ আবুল গারছ বলেন, এটা সত্যি যে, সামরিক দিক থেকে আমেরিকা বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। তবুও তাদের এমন সিদ্ধান্ত একেবারে মূল্যহীন। মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন মিত্র সৌদি আরব সরকারের দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, গোলান মালভূমিতে ইসরাইলি দখলারিত্ব মেনে নেয়ার যে উদ্যোগ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিয়েছেন, তা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব শান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বিবৃতিতে বলা হয়, গোলান মালভূমি একটি আরব ভূখণ্ড এবং তা আরবের অংশ হিসেবেই থাকবে। কানাডাও ইসরাইলি দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান মার্কিন উদ্যোগের নিন্দা জানিয়েছেন।
২০১৭ সালে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এক ঘোষণা জারি করেন ট্রাম্প। তার ওই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। এর পর ২০১৯ সালে এসে গোলান মালভূমিকে ইসরাইলের ভূখণ্ড বলে স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে তার ঔদ্ধত্যের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। ট্রাম্প গত বছর কেবল জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য দেয়া মার্কিন সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন ইহুদি বসতি সম্প্রসারণকে শান্তিপ্রক্রিয়ার সাথে কোনো বাধা নয় বলে মনে করে বলে ইসরাইলকে বসতি সম্প্রসারণে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটনে পিএলও’র অফিস বন্ধ করে দেয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের আসল লক্ষ্য হলোÑ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এবং কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়ে ইসরাইলের আধিপত্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গাজার ইসরাইলের সাথে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে প্রতিদিনই পাখির মতো গুলি করে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। এক সূত্র থেকে জানা গেছে, ইসরাইল গোলানের তেলের রিজার্ভের সন্ধান পেয়েছে। ওই তেল যাতে হাতছাড়া হয়ে সিরিয়ার কাছে যেতে না পারে সে জন্যই ইসরাইল মরিয়া হয়ে উঠছে বলে জানা গেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে সুবিশাল ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করতে চান। সে জন্যই তিনি জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা, ফিলিস্তিনি অফিস বন্ধ, ফিলিস্তিনিদের জন্য সহায়তা বন্ধ এবং সর্বশেষ গোলান মালভূমিকে ইসরাইলি ভূখণ্ড বলে স্বীকৃতি দেয়ার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ট্রাম্পের এসব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে আরব ও মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চার ভূমিকা পালন ও জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদসহ বিশ্ব সংস্থার মাধ্যমে আমেরিকায় ঔদ্ধত্যকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য মুসলিম বিশ্বকে নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য ও কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement