২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

থাইল্যান্ডের নির্বাচন : স্বচ্ছতার চেয়ে বিভ্রান্তি বেশি

-

আট বছর অনেক টালবাহানার পর গত ২৪ মার্চ থাইল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর এটিই প্রথম নির্বাচন। নির্বাচনে প্রধানত দু’টি পক্ষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকে। একটি পক্ষ সামরিক জান্তা সমর্থিত। অন্য পক্ষ থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় নেতা থাকসিন সিনাওয়াত্রা সমর্থিত গণতান্ত্রিক দল।
নির্বাচনে ৫০০ আসনের মধ্যে ৩৫০ আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এই ফল ঘোষণা নিয়েও হয়েছে অনেক নাটকীয়তা। ৯৩ শতাংশ ভোট গণনার পর দেখা যায়, ১২৯টি আসনে গণতন্ত্রপন্থী সিনাওয়াত্রার দল পিউ থাই পার্টি সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে আছে। আর সামরিক জান্তা সমর্থিত দল ১১৭টি আসনে এগিয়ে। এতে দেখা যাচ্ছে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। এখনো ১৫০টি আসনের ভাগ্য অনির্ধারিত রয়েছে। সরকার গঠনের জন্য থাই জাতীয় সংসদে ২৫১টি আসন প্রয়োজন। তাই যেকোনো বড় দলকে ছোট দলের সহায়তা নিতে হবে। গণনার পর দেখা গেছে সামরিক সমর্থিত দল পালং প্রচারথ পার্টি পপুলার ভোটের ৭৬ লাখ পেয়েছে। অপরদিকে, পিউ থাই পার্টি পেয়েছে ৭৫ লাখ ভোট।
নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা তিনবার বিলম্বিত করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। তবে কোনোবারই এর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। আগামী ৯ মে’র আগে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে নির্বাচনে অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে সেনাবাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক স্বাধীন পর্যবেক্ষকরাও থাইল্যান্ডের নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছেন।
সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা এক প্রবন্ধে নির্বাচনে বড় আকারে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন থাকসিন। থাইল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার কারচুপি করছে বলে অভিযোগ তার। ঘুষ দিয়ে সেনাবাহিনী ভোট কিনেছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের কথা জানিয়েছে পর্যবেক্ষক সংস্থা এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস-আনফ্রেল। থাইল্যান্ডের নির্বাচনে নিজেদের পর্যবেক্ষণ নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এর হেড অব মিশন রোহানা হেট্টিয়ারাচচি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড’ রয়েছে তা থাইল্যান্ডে মেনে চলা হয়নি। নির্বাচনী প্রস্তুতি চলার সময় থেকে শুরু করে নির্বাচনের দিন এমনকি ভোট গণনার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। জাতীয় পর্যায়ে ব্যালট গণনার জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে তা অস্বচ্ছ। এ প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
হেট্টিয়ারাচচি জানান, নির্বাচনী প্রস্তুতি চলার সময় থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ভোটারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে দেখা গেছে সেনাবাহিনীকে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিগোচর হয় না, এমন দুর্গম এলাকাগুলোতে ভোটারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে বেশি। একটি দলকে সুবিধা দেয়ার জন্য সরকার ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহার করেছে। বিশেষ করে গ্রাম এলাকাগুলোতে এমনটা করতে দেখা গেছে। একে ভোট কেনা বলে উল্লেখ করেছে আনফ্রেল। দেশজুড়ে সরাসরি ভোট বেচাকেনার এমন খবর পাওয়া গেছে। তবে কেউ প্রমাণ নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেনি।
থাইল্যান্ডের মানুষের কাছে সামরিক শাসন নতুন অভিজ্ঞতা নয়। তবে এটি কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থা না। সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক দেশ থাইল্যান্ড। দেশটি কখনই কোনো বিদেশী শক্তির উপনিবেশ ছিল না। যদিও এশিয়ার বেশির ভাগ দেশেই ঔপনিবেশিক শাসন জারি ছিল। এখানে সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক স্বয়ং রাজা। ১৯৩২ সাল হতে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটিতে সামরিক শাসন বহাল ছিল। নানান চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালে থাইল্যান্ডে একটি গণতন্ত্রসম্মত শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। সেই সংবিধানের অধীনে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে থাকসিন সিনাওয়াত্রার নেতৃত্বাধীন পার্টি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। পরবর্তী মেয়াদেও এই পার্টির জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে। ২০০৬ সালে থাকসিন সরকারকে উৎখাত করে ব্যাংককে প্রতিষ্ঠিত হয় সেনাসমর্থিত বেসামরিক সরকার। টেলি কমিউনিকেশন দুর্নীতির অভিযোগ এনে ক্ষমতাচ্যুত থাকসিনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় এবং দণ্ড প্রদান করা হয়। তার আগে সিনাওয়াত্রা দেশ ত্যাগ করেন।
২০১০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে পতন ঘটে সেনা সমর্থিত সরকারের। পরের বছর সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে থাকসিন সিনাওয়াত্রার বোন ইংলাকের নেতৃত্বাধীন পুয়ে থাই পার্টি। ইংলাক হন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৩ সালের অক্টোবরে পার্লামেন্টে দায়মুক্তি বিল পাস করায় ইংলাক সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিরোধীরা। সেই সময়ে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে ক্ষমতাসীন পুয়ে থাই পার্টি (পিটিপি) জিতে যায়। এরপর থাইল্যান্ডের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে শতাধিক ভোটের ব্যবধানে ইংলাক সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। এরপরেও নির্বাচিত সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিরোধী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এই পরিস্থিতিতে ইংলাক সরকার ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয় এবং পুনরায় সরকার গঠন করে। আন্দোলনও থাকে অব্যাহত। ওই বছর ৭ মে সাংবিধানিক আদালতের রায়ে ইংলাক সিনাওয়াত্রা প্রধানমন্ত্রী পদ হতে অপসারিত হন। পরে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু সেই সরকার বেশি দিন টিকেনি। সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করায় সেই সরকারেরও অবসান ঘটে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল প্রাউৎ চান ওঁচা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। তিনি সংবিধান বাতিল করেন। মৌলিক অধিকার স্থগিত করেন। একই সাথে সেনাবাহিনী প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সেই থেকে ২৪ মার্চ ২০১৯-এর নির্বাচন পর্যন্ত সেনাবাহিনী দেশের সব কর্তৃত্ব পরিচালনা করে। সেনা অধিগ্রহণের গতানুগতিক ধারা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৭ আগস্ট তথাকথিত গণভোট দ্বারা তাদের প্রণীত নতুন সংবিধান অনুমোদিত হয়। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল থেকে তা কার্যকর করা হয়। এই সংবিধানের অধীনেই বর্তমান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ফল ঘোষণা স্থগিত হওয়ায় নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কি সুষ্ঠুভাবে ফলাফল ঘোষণা করা হবে নাকি সামরিকীকরণের পাকাপোক্ত কোনো পদক্ষেপ নেবে সরকার, সেটিই এখন দেখার বিষয়। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement