২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

থাইল্যান্ডে সেনাশাসন পোক্ত করার নির্বাচন

-

থাইল্যান্ডের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনা সাধারণত কমই হয়। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে প্রধান বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দলটির নির্বাহী বোর্ডের সদস্যদের নির্বাচনে অংশ নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে ১০ বছরের জন্য।
কেন নিষিদ্ধ করা হলো বিরোধী দলকে? থাইল্যান্ডের বিরোধী দল থাই রাকসা চার্ট, যারা রাজার বোনকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিয়েছিল, সেই দলকে নিষিদ্ধ করেছে থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত। নির্বাচনের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে এমন ঘটনায় দলটি ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়ে। এই দলটিসহ বিরোধী অন্যান্য দল, যারা সামরিক জান্তা সমর্থনকারী দলগুলোকে হারানোর পরিকল্পনা করছিল; তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে গেল বলেই মনে করা হচ্ছে।
থাই রাকসা চার্ট দলের প্রধান প্রিচাপোল পংপানিচ রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের সামনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি জানান, তারা আদালতের রায় মেনে নিয়েছেন। কারণ তারা সবাই দেশের ভালো চান। রায়ের পর দলটির সমর্থকদের কাঁদতে দেখা গেছে। তারা জানিয়েছেন, অন্য বিরোধী দলগুলোকেই ভোট দেবেন তারা। এর আগে দলটি রাজকুমারীকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিলে দেশটির নির্বাচন কমিশন দলটি নিষিদ্ধের জন্য আদালতে আবেদন করে। নির্বাচন কমিশনের দাবি, ওই মনোনয়ন রাজতন্ত্র আর সংবিধানের মধ্যে সঙ্ঘাতপূর্ণ।
১৯৭২ সালে উবলরতানা রাজকন্যা শ্রীবন্দনা বর্ণবাদী রাজকুমারী হিসেবে তার উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নানা দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। রাজা মাহা ভাজিরালংকর্ন অবশ্য তার বোনের মনোনয়নের বিরোধিতা করেছিলেন। এটাকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক বিশ্লেষক থিটিনান পংসুধিরাক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘থাই রাকসা চার্ট দলটিকে নিষিদ্ধ করার ফলে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হলো। কেননা দলটি থাকসিন সমর্থকদের নিয়ে একটা বড় দল গড়তে চলেছিল। এর ফলে জান্তা সমর্থিত দলগুলোর ভোট বাড়বে এবং থাকসিন সমর্থিত অন্য ছোট দলগুলোর সমর্থন কমবে বলে ধারণা করা যায়।’
বর্তমানে রাজকুমারী উবলরতানা জার্মানিতে অবস্থান করছেন বলে তার ইনস্টাগ্রাম পোস্ট থেকে জানা গেছে। আদালতের রায় সম্পর্কে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কেবল বলেছেন, ‘থাইল্যান্ডের জন্য আমি আমার কাজ অব্যাহত রাখব।’
থাইল্যান্ড টানা পাঁচ বছর সামরিক শাসনের অধীনে রয়েছে। সামরিক সরকার ওই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে যেন নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর ওপর তাদের প্রভাব বাড়ে বৈ না কমে। সামরিক ক্ষমতাধরেরা এমন ব্যবস্থাও করেছে, যাতে তাদের বিরোধী পক্ষ অর্থাৎ নির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সাথে যুক্ত দলগুলো নির্বাচনে বেশি আসন না পায়।
আগের দলগুলোর পরিসর কমানোর চেষ্টা চলছিল; এখন আবার নতুন যুক্ত হলো ‘থাই রক্ষা চার্ট’। গত নভেম্বরেই এর জন্ম। সবাই তখনই বুঝতে পেরেছিল, থাকসিনপন্থী প্রধান দল ‘ফিউ থাই’কে মজবুত করতে এবং থাকসিন ও তার সহযোগীদের ওপর নতুন সংবিধানে আরোপিত বিধিনিষেধ ভাঙতেই থাই রক্ষা চার্ট গঠন করা হয়েছে। এ অবস্থায় মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আট বছর পর অনুষ্ঠিতব্য প্রথম নির্বাচনে থাকসিনপন্থীরা আদৌ সরকার গঠনের মতো যথেষ্ট যোগ্যতা দেখাতে পারবে কি না। এই যোগ্যতা দেখানোর পূর্বপ্রচেষ্টা হিসেবেই থাই রক্ষা চার্ট রাজা ভাজিরালংকর্নের বড় বোন রাজকন্যা উবলরতানাকে দলের পক্ষ থেকে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। এক মুহূর্তে বদলে যায় থাই নির্বাচন নিয়ে সব সমীকরণ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাকে সমর্থন দেয়া দলকে।
থাকসিনের দল ফিউ থাই ২০১১ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। নতুন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অধীনে দলটির কোনোভাবেই সেবারের সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব নয়। কারণ আড়াই শ’ আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্যরা আগে থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের প্রায় সবারই জেনারেল প্রায়ুথের পক্ষে আগামী নির্বাচনে ভোট দেয়ার কথা।
তবে থাই সমাজে রাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ততা তাদের রাষ্ট্রধর্মের গভীরে প্রোথিত। বেশির ভাগ থাই নাগরিক রাজপরিবারের সাথে গভীর একটা আবেগের বন্ধন অনুভব করেন। তাই বলাবাহুল্য, রাজকন্যা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী থাকলে হয়তো বেশির ভাগ সিনেটর তাদের বিশ্বস্ততা রাজকন্যার প্রতি দেখাতেন। ওই আনুগত্যের সদ্ব্যবহার যেন থাই রক্ষা চার্ট নিতে না পারে, সে জন্যই সামরিক সরকার নিযুক্ত নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করেছে বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকেরা। এখন দেশটির ওপর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ যে আরো সুদূর হয়ে উঠবে সেই সম্ভাবনা প্রবলতর হয়ে উঠেছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জেনারেল প্রায়ুথ চানওচা পাঁচ বছর আগে এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা নেয়ার পরপরই তিনি কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তা রাখেননি। তিনি সামরিক জান্তা দুর্নীতি দমন, ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কোনোটাই রাখতে পারেননি। জান্তা একটি দল গঠন করে এবং সেই দলের প্রার্থী হিসেবে প্রায়ুথ চানওচা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন ফের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য। তার আগে জান্তা আইনকানুন রদবদল করে ওই ব্যবস্থা করে যে প্রধানমন্ত্রীকে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মিলিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন পেতে হবে। ২৫০ আসনের সিনেটের সদস্যরা জান্তার নিয়োগপ্রাপ্ত। আর ৫০০ আসনের নি¤œ পরিষদের সদস্যরা সবাই নির্বাচিত। সুতরাং জান্তার দলের প্রার্থীর নিম্ন পরিষদের মাত্র ১২৬ জন সদস্যের সমর্থন পেলেই চলবে।
সব কিছু আরো স্পষ্ট হয় ১১ ফেব্রুয়ারি। রাজ অনুগত নির্বাচন কমিশন ওই দিন উবলরতানার মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করে। হতাশায় ভেঙে পড়ে থাই রাকসা চার্ট। তাদের সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অন্য দিকে রাজতন্ত্রবাদী সামরিক এলিট শ্রেণী ও রক্ষণশীল যারা উবলরতানার প্রার্থিতা ঘোষিত হওয়ার পর থেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। উবলরতানা ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দেন, দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করার ব্যাপারে তার ঐকান্তিক আগ্রহ নিয়ে এত সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তিনি ক্ষমা প্রার্থী।
যাই হোক, জেনারেলরা যে স্কিম নিয়ে এগোচ্ছিলেন সেটাই এখন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। প্রায়ুথই আবার হতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ২৪ মার্চের নির্বাচন হয়তো একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

 


আরো সংবাদ



premium cement