২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আফগান যুদ্ধ : যেভাবে হারল আমেরিকা

-


ছবি নাকি কথা বলে। যদি তাই হয়, তবে ব্রিটিশদের আফগান যুদ্ধে পরাজয়ের কাহিনীর একটি ছবি না বলা অনেক কথাই বলে দেয়। ছবিটি এঁকেছিলেন এলিজাভেথ বাটলার। তাতে প্রথম ইঙ্গো-আফগান যুদ্ধের (১৮৩৯-১৮৪২) একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ১৮৪২ সালে ঘোড়ার পিঠে করে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল অফিসার উইলিয়াম ব্রাইডনের কাবুল থেকে জালালাবাদ পৌঁছার কথা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ব্রাইডন আহত হয়েছেন, তার ঘোড়াটির দম ফুরিয়ে আসছে। ১৬ হাজার সৈন্য ও ক্যাম্প অনুসারীর মধ্যে কেবল তিনিই বেঁচেছিলেন।
এর ১৩০ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অনুগত কমিউনিস্ট দেশ আফগানিস্তানে হামলা চালায়। একটি দশক শেষ হওয়ার আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে হয়। তারপর ২০০১ সালে সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র তার ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করতে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়। এখন ১৭ বছরের যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান নীতিগতভাবে একটি শান্তি কাঠামোতে পৌঁছেছে। এতে আমেরিকানরা তাদের মুখ রক্ষা করতে পারবে। তবে ইতিহাসের কথাই অনুরণিত হচ্ছে তাতে।
আফগানিস্তান ঐতিহাসিকভাবেই বহিরাগত হানাদারদের জন্য কঠিন স্থান। এর কারণ হলোÑ এর জটিল গোত্রীয় সমীকরণ, এর দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। এটি হলো ভূগোলে নির্ধারিত ভূরাজনীতির নিয়তির অনন্য উদারহণ হলো এই দেশ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার ‘গ্রেট গেমের’ অংশ হিসেবে ১৮৩৮ সালে সৈন্য পাঠিয়েছিল। তারা ভয় পাচ্ছিল যে, রুশরা আফগানিস্তান দখল করে ‘ব্রিটিশ মুকুটের রতœ’ ভারত সীমান্তে চলে আসবে। ওই ধারণায় বশবর্তী হয়ে তারা কাবুল জয় করে, আফগানিস্তানের আমির দোস্ত মোহাম্মদ খানকে উৎখাত করে ক্ষমতায় বসায় তাদের হাতের পুতুল শাহ শুজা দুরানিকে। প্রধানত দোস্ত মোহাম্মদের ছেলে আকবার খানের নেতৃত্বে উপজাতীয় যোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে অভিযানটি যখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, তখন ব্রিটিশরা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রত্যাহারের সময় ব্রাইডন ছাড়া তাদের সব সৈন্য ধ্বংস হয়ে যায়। দোস্ত মোহাম্মদ আবার কাবুল দখল করেন।
সোভিয়েতরাও একই ভুল করে। আন্তঃদলীয় অভ্যুত্থানের পর তারা আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠিয়েছিল। সোভিয়েতরা হাফিজুল্লাহ আমিনকে নিয়ে চিন্তায় ছিল। তিনি ১৯৭৮ সালের কমিউনিস্ট ক্যুয়ের নেতা নূর মোহাম্মদ তারাকিকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে লিউনিদ ব্রেজনেভ আফগানিস্তানে সৈন্য মোতায়েন করেন। সোভিয়েতরা আরেকটি ক্যু করেছিল। তারা আমিনকে হত্যা করে বাবরাক কারমালকে স্থলাভিষিক্ত করেছিল। মস্কোর বশংবদ কারমাল হন প্রেসিডেন্ট। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয় ও ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরান হারানোর পর আমেরিকানরা আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা মুজাহিদিনদের সমর্থন করতে শুরু করে। মুসলিমবিশ্বে সমাজতন্ত্রের বিস্তার নিয়ে উদ্বিগ্ন পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সাহায্য নিয়ে তারা কমিউনিস্ট সরকার ও তাদের সোভিয়েত সমর্থক উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। এক দশক পর সোভিয়েতরা বুঝতে পারে, দখলদারিত্ব টিকবে না। তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান শাসকদের ওপর হামলা চালানোর সময় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন, বিশ্বের প্রতিটি সন্ত্রাসী গ্রুপকে বের করে তাদের থামানো ও পরাজিত না করা পর্যন্ত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বন্ধ হবে না। তালিকাটি দীর্ঘ। মার্কিন সৈন্যরা সহজেই তালেবানকে পরাজিত করে। তারপর হামিদ কারজাইকে প্রেসিডেন্ট করার মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৭ বছরের যুদ্ধের পর যুদ্ধটি এখন অচলাবস্থায় রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে হতাহতের পরিসংখ্যান প্রণয়ন শুরু করে। দেখা যায়, প্রায় ২০ হাজার আফগান বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো ৫০ হাজার। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে ব্যয় করেছে প্রায় ৮৭৭ বিলিয়ন ডলার। তারা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তাদের অন্তত দুই হাজার সামরিক ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে।
আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়ে কী পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র? ২০০১ সালে তালেবান পক্ষ পিছু হঠে গিয়েছিল। তারা এখন ফিরে এসেছে। অনেকের হিসাব অনুযায়ী, তারা আফগানিস্তানের অর্ধেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে। পার্বত্য এলাকার বেশির ভাগই তাদের হাতে। আর পূর্ব দিকে ইসলামিক স্টেট তাদের অবস্থান জোরদার করছে। আর সরকার ভয়াবহ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েকবারই নিশ্চিত করেছেন, তিনি আমেরিকান সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনতে চান। অবশ্য তারপরও তিনি তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জোরদার করতে ২০১৭ সালে আফগানিস্তানে সৈন্য বাড়িয়েছিলেন। এর পর থেকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু তালেবানের অগ্রযাত্রা রুখতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তালেবান তাদের আধিপত্য বাড়িয়েই চলেছে।
প্রশ্ন হলোÑ এরপর কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা তালেবানের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছে যে গ্রুপটি আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী গ্রুপকে নিরাপদ আশ্রয় দেবে না। যুদ্ধবিরতি ও আন্তঃআফগান আলোচনার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তালেবানের কাছে ইতোমধ্যেই অনেক কিছু ছেড়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তালেবান বলেছে, তারা আফগান প্রশাসনের সাথে কথা বলবে না, তারা আফগান সরকারকে বৈধ মনে করে না। আমেরিকানরা তা মেনে নিয়ে তালেবানের সাথে সরাসরি আলোচনা করেছে। তালেবান শক্তিশালী অবস্থানে থেকে আলোচনা চালাচ্ছে। তালেবানের ভবিষ্যৎ ভূমিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো সমঝোতা না করেই যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে হেরে গেছে এবং তারা এখন আফগানিস্তান থেকে বের হয়ে যেতে চায় যেকোনো মূল্যে। তারা তালেবানের শর্ত মেনেই সরে যেতে চাচ্ছে।
এখন সবাই ধরে নিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের দিন শেষ। তালেবানের কাবুলের মসনদে বসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আরেকটি সাম্রাজ্যবাদের কবর রচিত হলো আফগানিস্তানে। হ


আরো সংবাদ



premium cement

সকল