২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটি বিয়ে এবং শ্রীলঙ্কার রাজনীতি

-

বিয়ে অনুষ্ঠান এমনো হতে পারে! জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হতেই পারে। উপমহাদেশ, কিংবা এশিয়া নয়, সারা বিশ্বেই সম্পদ, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের জন্য বিয়ে অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়। রাজ-রাজাদের পরিবার সদস্যদের বিয়ে বেশ ঘটা করেই হয় এবং তা ব্যাপকভাবে আলোচিতই হয়। সম্প্রতি প্রতিবেশী ভারতেও বেশ কয়েকটি আলোচিত বিয়ের অনুষ্ঠান দেখা গেছে।
তবে শ্রীলঙ্কার একটি বিয়ে অনুষ্ঠান নিয়ে দেশটিতে হইচই থামছেই না। বিয়েটি হয়েছে ২৪ জানুয়ারি। কিন্তু এখনো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এটিই প্রধান বিষয়। শ্রীলঙ্কার বর্তমান বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসের ছেলে রহিত রাজাপাকসের সাথে তার দীর্ঘ দিনের গার্লফ্রেন্ড তাতিয়ানা লি জয়ারতেœর বিয়েটি হয়। তার রেশ দেখা যাচ্ছে এখনো। সামাজিক মিডিয়ার একটি পোস্টে বলা হয়েছেÑ ‘রনিল আঙ্কেল ছিলেন মহিন্দা আঙ্কেলের ছেলের বিয়ের প্রধান অতিথি। তাই ঈশ্বরের দোহাই, রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে নিজেকে গ্রামের অন্যদের থেকে আলাদা করবেন না।’
সত্যিই অবাক করা অনুষ্ঠান ছিল এটি। অতিথিদের বিয়ে অনুষ্ঠান উপভোগের যে ভিডিও দৃশ্য দেখা গেছে, তাতে এমনকি ভাসা ভাসা চোখে দেখা লোকজনের চক্ষুও কপালে ওঠার কথা। রাজনৈতিক মঞ্চে একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডতমভাবে আক্রমণকারী লোকজন এখানে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছেন, আনন্দ করছেন, হাসছেন, ফুর্তি করছেন। দেখে মনেই হবে না, তারা একজন অন্যজনকে পরাজিত করতে কী চেষ্টাই না করছেন। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে এটি সম্ভবত সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে। দেশ যখন অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে, তখন এ ধরনের বিপুল আয়োজনের সামর্থ্য খুব কম লোকেরই আছে। তবে ব্যয়বহুলের জন্য নয়, কারা তাতে উপস্থিত ছিলেন, তারা কিভাবে বিয়ে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছেন আর তাই চর্চার আসল বিষয়।
রাজাপাকসাকে দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য অভিযোগকারী রনিল বিক্রমাসিঙ্গেকে পুরো রাজাপাকসে পরিবার উষ্ণভাবে স্বাগত জানান। মনে হচ্ছিল, তিনি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নন; তাদের ঘনিষ্ঠতম স্বজন। রাজাপাকসা আর বিক্রমাসিঙ্গে যে কত আপন লোক, তা কি রাজনৈতিক শিবিরের লোকজন জানে?
রাজাপাকসের তীব্র সমালোচকদের একজন হলেনÑ অর্থমন্ত্রী মঙ্গলা সামারাবিরা। তিনি রাজাপাকসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে আসছিলেন। বিয়ে অনুষ্ঠানে তাকে যেভাবে উল্লসিত দেখা গেল, তাতে তার কোনো ভূমিকাটি সত্য, তাই এখন ভাবনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ডিনারে রাজাপাকসেকে বিক্রমাসিঙ্গের ঠিক বিপরীত স্থানে বসে থাকতে দেখা যায়। পাশ ছিলেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটাবায়া রাজাপাকসে। অনেক সময় তাকেই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে ডিনার অনুষ্ঠানে মনে হয়েছে, বিক্রমাসিঙ্গে হলেন রাজাপাকসাদের হারানো অতিথি। তাকে সমাদর করার মধ্যে কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যায়নি।
শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক মঞ্চের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন বিয়ে অনুষ্ঠানে। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজনের অনুপস্থিতির বিষয়টিও নজর এড়ায়নি। তিনি হলেনÑ প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা। তিনি এখন সরকারি সফরে সিঙ্গাপুর রয়েছেন। তবে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, সিঙ্গাপুর রওনা হওয়ার আগে তিনি তাদের বাড়ি গিয়ে বর-কনেকে উপহার দিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার রাজনীতির কলাকুশলীদের কেউ বাদ থাকেনি এই আসরে।
তবে এই বিয়ে অনুষ্ঠান দেখে যারা দেশটির বিভক্ত রাজনীতিতে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন, তাদের সেই স্বস্তি খুব বেশি সময় থাকবে বলে মনে হয় না। শিগগিরই প্রাদেশিক কাউন্সিল আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই শুরু হবে। মুহূর্তেই আনন্দঘন অনুষ্ঠানটি তিক্ততায় পরিণত হতে পারে।
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যত হইচই হচ্ছে, ততটাই নীরবতা রয়েছে প্রাদেশিক কাউন্সিলের নির্বাচনের বিষয়টি। ধারণা করা হচ্ছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মহিন্দা রাজাপাকসার নতুন দল শ্রীলঙ্কা পদু জনা পেরামুনার (এসএলপিপি) কাছে রনিল বিক্রমাসিঙ্গের ইউএনপির পরাজয়ের পর তারা আর নির্বাচনের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কারণ তাদের শঙ্কা প্রাদেশিক কাউন্সিলের নির্বাচনেও তাদের ভরাডুবি হবে। এই প্রেক্ষাপটেই সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রাদেশিক কাউন্সিলের নির্বাচন না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে নানা হিসাব কষছেন রনিল বিক্রমাসিঙ্গে। এ দিকে, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার সাথেও তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। তাকে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী করতে পারছেন না। এমন অবস্থায় তিনি সিরিসেনার এসএলএফপির কিছু সদস্যকে তার দলে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন।
এ দিকে, সিরিসেনা এখনো রাজাপাকসাদের সমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। যদিও মহিন্দা রাজাপাকসার ছোট ভাই গোটাবায়া রাজাপাকসা ও বড় ভাই চমল রাজাপাকসা গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছেনÑ তারা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারেন; কিন্তু তবুও হাল ছাড়েননি সিরিসেনা।
রাজাপাকসার ছেলের বিয়ের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে এখন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা কিভাবে একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য মাঠে অবতীর্ণ হনÑ সেটিই এখন দেখার বিষয়। আর তাতে কে জয়ী হবেন, সেটিও দেখার বিষয়।


আরো সংবাদ



premium cement