২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সিরিয়ায় রক্তপাত বন্ধে তুরস্ক ও রাশিয়া কি সফল হবে?

-


তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান এবং তার রুশ প্রতিপক্ষ ভøাদিমির পুতিন শিগগিরই বৈঠকে মিলিত হবেন। তারা সিরিয়া নিয়ে আসন্ন শীর্ষ বৈঠকের ব্যাপারে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে। তুর্কি কর্মকর্তারা চলতি সপ্তাহে নিশ্চিত করেছেন আগামী সপ্তাহগুলোতে সিরিয়া প্রশ্নে আলোচনা করার জন্য তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের একটি শীর্ষ বৈঠকে বসার পরিকল্পনা আছে। তবে বৈঠকের কোনো তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি বলে তারা জানিয়েছেন।
এই ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকের আগে মনে হয়, রুশ ও তুর্কি নেতারা একত্রে বৈঠকে বসে সেফ জোন বা নিরাপদ অঞ্চল, সিরীয় কুর্দি এবং সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করবেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ বলেছেন, পরিকল্পনার সময় সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে প্রস্তাবিত ২০ মাইল নিরাপদ অঞ্চলের বিষয় এবং সিরিয়ায় তুরস্কসহ সব পক্ষের স্বার্থ মস্কো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটির সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় প্রভাবশালী দেশ হিসেবে রাশিয়া তার অবস্থানকে আরো জোরদার করেছে। সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আঙ্কারা সঙ্কট নিরসনে রাশিয়া ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছে। ২০১৭ সালের প্রথমার্ধ থেকে রাশিয়া তুরস্কের একটি ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে বিশ্বাস অর্জন করেছে। আসতানা শান্তিপ্রক্রিয়াকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ এ শান্তিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সিরিয়ায় যুদ্ধের প্রকোপ হ্রাস করার উদ্যোগ কার্যকর হয়। রাশিয়া তুরস্ক এবং ইরান আসতানা শান্তিপ্রক্রিয়ার গ্যারান্টার এবং ফলে এ তিন দেশের নেতারা সিরিয়া সঙ্কট নিয়ে প্রায় বৈঠকে মিলিত হয়ে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রে সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারসংক্রান্ত তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যে জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে, সে ব্যাপারে আঙ্কারা ভালোভাবে সতর্ক রয়েছে। এ কারণে তুরস্ক অপর দুই দেশের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরস্ক দেশ দু’টির সাথে গভীরভাবে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভোসগ্নু বলেন, ‘আপনি পছন্দ করেন বা না করেন ইরান সিরিয়ায় একজন অভিনেতা। তিনি বলেন, ‘তাই বর্তমান অভিনেতাদের সাথে আমাদের গঠনমূলকভাবে কাজ করা প্রয়োজন।’
সব দেশ সিরিয়ায় তাদের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কাজ করছে। সিরিয়া থেকে মার্কিন সেন্য প্রত্যাহারের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে তুরস্ক অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। কারণ এ সিদ্ধান্তের পর দেশটিতে সম্ভবত ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসবে। পরিস্থিতি জটিল হওয়ার কারণে অন্য পক্ষগুলোর সাথে তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সেই যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য সাবধানে এগোচ্ছে। সিরিয়ার আট বছরের যুদ্ধ থেকে অনেক শিক্ষা নেয়ার আছে। বিশেষত তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত যারা পরিবর্তন চায় তাদের প্রতিশ্রুতির শক্তি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এটা গুরুত্বপূর্ণ, এ পর্যায়ে সিরিয়ার সরকারবিরোধী শক্তি এবং তাদের মিত্র তথা তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্যদের প্রতিশ্রুতির শক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। আর যারা বর্তমান অবস্থা বজায় রাখতে চায় অর্থাৎ সিরিয়া সরকার এবং তাদের মিত্র রাশিয়া ও ইরান সম্পর্কে জানতে হবে। তারা কী করতে চায় এবং তাদের প্রতিশ্রুতির বিষয় জানা থাকতে হবে।
যুদ্ধের প্রথম দিকে বেশ কিছু দেশ নিজেদের ‘সিরিয়ার বন্ধু’ বলে ঘোষণা দিয়ে সিরিয়ার সরকার বিরোধীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। তারা সভা-সমাবেশ এবং সাহসী বিবৃতিও দিয়েছিল। কিন্তু গত আট বছরে দেখা গেলÑ বাশার আল আসাদের পতনের জন্য বহু সভা সমাবেশ ও সাহসী বক্তৃতা-বিবৃতির পরও বাশারের মিত্র রাশিয়া ও ইরান তাকে ত্যাগ করেনি। এখন ওই দুই দেশ যুদ্ধের নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যর্থ হলেও দেখা যাচ্ছে যুদ্ধে তারাই জয়ী হয়েছে। কারণ বাশার আল আসাদ এখনো তার অবস্থানে বহাল আছেন। হাজারো প্রচেষ্টা ও যুদ্ধ সত্ত্বেও তার পতন হয়নি।
দ্বিতীয় শিক্ষা হলো : ময়দান বা স্থলভাগে বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রক্ষিতে জোট বা মিত্র শক্তিগুলো কিভাবে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। সিরিয়ায় এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছেÑ গতকালের শত্রু আগামী দিনে বন্ধু হয়ে যেতে পারে। নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সিরিয়ায় বিভিন্ন দেশ নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে অন্য দেশের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে এবং ঐতিহাসিকভাবে নতুন অবস্থান গড়ে তুলেছে।
এ ক্ষেত্রে আমরা তুরস্ক ও আমেরিকার মধ্যকার সম্পর্কের কথা বলতে পারি। আমেরিকা গত সাত বছরে সিরিয়ার সরকার বিরোধী শক্তি এবং তাদের মিত্রদের সাথে বেশ কয়েকবার প্রতারণা করেছে। আর আমেরিকার এ ধরনের ভূমিকার কারণে সিরিয়ায় হাজার হাজার মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। রাশিয়া ও ইরান তাদের মিত্র বাশার আল আসাদকে রক্ষা করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও আমেরিকা তার মিত্রদের পক্ষে শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি। তাই হাজার হাজার সিরীয় নাগরিকের মৃত্যুর দায়ভার আমেরিকাও বহন করতে হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পর সম্প্রতি আমেরিকা সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রক্সি-যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে দেশটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জনগণ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তৃতীয় ও বড় শিক্ষা হচ্ছেÑ সিরিয়া যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বাস্তু সঙ্কট নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে। কিভাবে তারা ব্যর্থ হয়েছে তা থেকে অবশ্যই শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। বিপুল বেসামরিক সিরীয় নাগরিক যারা যুদ্ধের সময় পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষার আকুতি জানিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশু মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন। যুদ্ধের সময় উদ্বাস্তুদের মধ্যে ৮০ শতাংশই হচ্ছে নারী ও শিশু। তারা ছিল দুর্বল ও অসহায়। তাদের অনেকেই মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। এটা বিশ্ব সম্প্রদায় ও মানবতার জন্য অত্যন্ত লজ্জার।
মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর পরবর্তী পরিস্থিতি মোকোবেলার জন্য তুরস্ক ও রাশিয়া প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিরিয়ার কুর্দি নিয়ন্ত্রিত মানবিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে তুরস্ক প্রস্তুত বলে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে ফোনালাপে জানিয়েছেন। সিরিয়ায় আর কোনো রক্তপাত কাম্য নয়। তুরস্ক ও রাশিয়া সেখানে ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে বলেই পর্যবেক্ষক মহল আশা করে।


আরো সংবাদ



premium cement