২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভারতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবেন মোদি?

-

ভারতীয় লোকসভা নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই রাজনৈতিক মেরুকরণ সুনির্দিষ্ট অবয়ব পেতে শুরু করেছে। সর্বশেষ দেশটির বৃহত্তর রাজ্য উত্তর প্রদেশে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক দল অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ও কুমারী মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টির (বিএসপি) মধ্যে জোট গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই জোট গঠনের পর সর্বশেষ জনমত জরিপে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের আসন সংখ্যা ২৪৫ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি আসনের মধ্যে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ ১৪৬টি এবং অন্য দলগুলো ১৫২ আসনে জয় পেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইন্ডিয়ান টিভি ও সিএনএক্স-এর যৌথ জনমত সমীক্ষায়। এই জানুয়ারি মাসেই ভিডিপি অ্যাসোসিয়েটসের চালানো জনমত জরিপে এনডিএ’র এই আসন ২২৫টি, ইউপিএ’র আসন ১৬৭টি এবং অন্যান্য দলের আসন ১৫০-এ দাঁড়াতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ চালানো এই দুই জরিপ অনুসারে ৫৪৩ আসনের লোকসভায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
২০১৯ সালের শুরু থেকেই একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ খবর আসছে বিজেপির জন্য। অতি সম্প্রতি তড়িঘড়ি করে মোদির মন্ত্রিসভা সাধারণ ক্যাটাগরিতে থাকা অর্থনৈতিকভাবে (উচ্চবর্ণের) দুর্বল লোকজনের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় ১০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করেছে। এসব মানুষ আগে কোনো কোটা সুবিধা পেত না। দ্বিতীয় খবরটি হলো ভারতের সেন্ট্রাল স্যাটিস্টিক্যাল অফিস (সিএসও) থেকে দেয়া জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে এ বছর ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে মর্মে বলা হয়েছে। তৃতীয় বড় খবরটি হলো মধ্য রাতে সিবিআই প্রধান অলোক ভার্মাকে অপসারণের যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দিয়ে তাকে পুনর্বহাল করেছে। চতুর্থ খবরটি হলো মন্ত্রিসভায় নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল অনুমোদন, যার জের ধরে আসামের বিজেপি সরকার থেকে শরিক দল অসম গণপরিষদ (এজিপি) বেরিয়ে গেছে।
বর্তমানে যে সংবিধান রয়েছে তাতে সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পরা অংশের জন্য কোনো কোটা সুবিধা দেয়া হয়নি। তাতে শুধু সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়াদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা রাখা হয়েছে। সরকার পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনী বিল এনেছে। এটি যে একটি নির্বাচনী চমক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব করে বিজেপি আগামী এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে ভোট প্রাপ্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল করতে চায়।
এত কিছুর পরও আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের জনমতের এই প্রবণতা আগামী দুই থেকে আড়াই মাসে কতটা পরিবর্তন মোদির সরকার করতে পারবেন তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে। ৫ বছর আগে বিজেপি একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল নরেন্দ্র মোদি তরঙ্গের ওপর ভর করে। বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল তখন ২৮২, এনডিএ’র ছিল ৩৩৬টি। এর বিপরীতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-এর প্রাপ্ত আসন ছিল ৬০, যার মধ্যে কংগ্রেসের ছিল মাত্র ৪৪টি। সে সময় মোদির ‘আচ্ছে দিন’ আর চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে জনগণ যেভাবে আস্থা রেখেছিল এবার সে আস্থায় অনেক বেশি পরিমাণে চিড় ধরেছে বলে মনে হচ্ছে।
আগামী লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে দু’টি বিষয় ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রথম বিষয়টি হলো দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখা অথবা বিশ্বাস অর্জন করা। দ্বিতীয়টি হলো বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও দলগত মেরুকরণ।
রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে এনডিএ ও ইউপিএ এ দুই জোটের মধ্যেই এখনো পর্যন্ত মেরুকরণ সীমিত রয়েছে। এক দু’টি দল উভয় জোট থেকে বিদায় নিয়েছে। আবার যোগও দিয়েছে দুয়েকটি দল। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এক সময় বিজেপি বিরোধী জাতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। সে প্রচেষ্টায় খুব বেশি তিনি এগোতে পারেনি। ইউপিএ’র সাথে পুরনো দলগুলোর বাইরে উল্লেখযোগ্য কোনো সংযোজন এখনো ঘটেনি। তবে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে অঞ্চলভিত্তিতে জোট হওয়ার কারণে সার্বিক ফলাফলে এর প্রভাব দেখা দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
উত্তর প্রদেশে এসপি-বিএসপি সমান ৩৮টি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সমঝোতার কথা ঘোষণা করেছে। এতে এই দুই দলের মিলিত ভোট বিজেপিকে ছাড়িয়ে যাবে। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীর আসনে এ জোট কোনো প্রার্থী দেবে না। এর ফলে ইন্ডিয়া টিভির জরিপ অনুসারে এনডিএ’র আসন ৭৩ থেকে ২৯-এ নেমে আসতে পারে। আর এসপি-বিএসপির আসন দাঁড়াবে ৪৯-এ। কংগ্রেস উত্তর প্রদেশে দু’টি এবং অন্যান্য দল তিনটি আসনে জয় পেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে জরিপে। গতবার ৪০ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে বিজেপি ৯০ শতাংশ আসন পেয়েছিল উত্তর প্রদেশে। এবার এসপি-বিএসপি জোটবদ্ধ হওয়ার ফলে ফলাফল উল্টোমুখী রূপ নিতে পারে।
বিহারে গতবার বিজেপি, নিতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) ও লালু যাদবের আরজেডি আলাদা নির্বাচন করায় বিজেপি ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। পরবর্তী বিধান সভার নির্বাচনে আবার নিতীশের জনতা দল (ইউ), লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) ও কংগ্রেস মিলে মহাজোট করলে বিজেপি হেরে যায়। কিন্তু পরে নিতীশের জেডিইউ এবং লালুর আরজেডির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলে নিতীশ বিজেপির সাথে মিলে সরকার গঠন করে। এ মেরুকরণের কারণে বিজেপির সমর্থন কমার পরও এনডিএ’র আসন ২৭টিতে দাঁড়াতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আরজেডি জোট ১৩ এবং কংগ্রেস দু’টি আসন পেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিহারে নিতীশ-লালু-কংগ্রেসের মধ্যে আগের মতো জোট হলে বিজেপির আসন এক অঙ্কে নেমে আসার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সে ধরনের মেরুকরণ সম্ভবত হচ্ছে না। তবে এসপি-বিএসপি-আরজেডির সাথে কংগ্রেসের বোঝাপড়া হলেও বিহারে এনডিএ’র আসন আরো কমে যেতে পারে।
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ সাত রাজ্যকে এবার প্রধান লক্ষ্য বানিয়েছে। বাংলাদেশী হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিল এনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সমর্থন বাড়াতে পারবে বলে ধারণা করছে। এতে বিজেপির আসন সংখ্যা ২ থেকে বেড়ে ১০-এ বেড়ে যাবে আর তৃণমূলের আসন ৩৪ থেকে কমে ২৬-এ দাঁড়াতে পারে বলে জরিপে বলা হয়েছে। তবে কংগ্রেস ও তৃণমূল জোট হলে বিজেপি এত আসন নাও পেতে পারে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যে এবার বিজেপি ভালো করবে বলে জনমত জরিপে বলা হচ্ছে। এই সাত রাজ্যের ২৫ আসনের মধ্যে ১৭টি বিজেপি পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নাগরিকত্ব বিল নিয়ে আসাম গণপরিষদের এনডিএ ত্যাগের পর সেই দৃশ্যপট পাল্টেও যেতে পারে। আসাম ও ত্রিপুরায় বিশেষভাবে এর প্রভাব পড়বে। এই দুই রাজ্যে বিজেপির সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে স্থানীয় দলগুলোর সাথে জোটবন্ধন। এটি অকার্যকর হয়ে গেলে তা বিজেপিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
হিন্দি বলয়ের তিনটি রাজ্যে বিজেপির পরাজয় তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। বিজেপি ঝাড়খণ্ডে ১৪টির মধ্যে সাতটি, মহারাষ্ট্রে ৪৮টির মধ্যে ২২টি, হরিয়ানায় ১০টির মধ্যে আটটি, কর্নাটকে ২৮টির মধ্যে ১৫টি, দিল্লির সাতটির মধ্যে পাঁচটি, হিমাচলে চারটির মধ্যে সব ক’টি এবং গুজরাটে ২৬টির মধ্যে ২৪টি আসনে জয় পেতে পারে বলে জরিপে বলা হয়েছে। এর মধ্যে গুজরাটে রাজ্যসভা নির্বাচনে যে ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে এত আসনে জয়ী হওয়া বেশ কঠিন বিজেপির জন্য।
ভারতের দক্ষিণ জোনে বিজেপির ফলাফল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এবারো দেখা যাচ্ছে না। জরিপ অনুসারে তেলাঙ্গানায় ১৭টি আসনের মধ্যে বিজেপি একটিও পাচ্ছে না। অন্ধ্র প্রদেশের ২৫ আসনের মধ্যেও বিজেপির সম্ভাব্য আসন শূন্য। তামিলনাড়ুর ৩৯টি আসনেও একই অবস্থা। পাঞ্জাবের ১৩টি আসনের মধ্যেও বিজেপি কোনো আসন পাবে না বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। এর বাইরে জম্মু কাশ্মিরের ছয়টি আসনের মধ্যে দু’টি, গোয়ার দু’টির মধ্যে একটি, রাজস্থানের ২৫টির মধ্যে ১৫টি, ছত্রিশগড়ের ১০টির মধ্যে পাঁচটি, উড়িষ্যার ২১ আসনের মধ্যে বিজেপি আটটিতে জয় পেতে পারে জরিপ অনুসারে। কংগ্রেসের কাছে হিন্দু হার্টল্যান্ডের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হারানোর পর থেকেই সরকার ও ক্ষমতাসীন দল বিজেপি আতঙ্কে ভুগছে। বিজেপি এখন যেকোনো মূল্যে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হতে চায়। এখানে নির্বাচনে জয়ী হওয়াটাই মুখ্য, ভারতের জনগণের কল্যাণ করা নয়। বিজেপির সামনে বাকি যে সময় আছে তাতে উচ্চ শ্রেণীর জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, পাকিস্তান-বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য নাগরিকত্ব বিল এবং আসন বাজেটে কিছু নাগরিক সুবিধাদানের ব্যবস্থা থাকতে পারে। এর বাইরে হিন্দুত্ব এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে রামমন্দির নির্মাণের ইস্যুটি আবারো চাঙ্গা করতে পারে দলটি। কিন্তু এসব করে বিজেপির জয় নিশ্চিত করা কঠিন। ভারতের জনমত জরিপে যে প্রবণতা এখন দেখা যাচ্ছে তাতে প্রতিনিয়ত বিজেপির প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। ২০১৮ সালের শেষ দিকের জরিপেও মনে হচ্ছিল এনডিএ’র আসন কিছুটা কমলেও মোদির নেতৃত্বেই সরকার গঠন হবে। এখন মনে হচ্ছে এনডিএ’র বিপরীতে কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে কোনো জোটগত মেরুকরণ হলে ২০১৯ সালে ভারতে আরেকটি অ-বিজেপি সরকার গঠনের সম্ভাবনা প্রবল। সে ক্ষেত্রে রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী না হলেও কোনো আঞ্চলিক দলের নেতাও হতে পারেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। হ


আরো সংবাদ



premium cement