২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও সিরিয়া যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি

-

আর মাত্র কয়েক দিন পরই মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাবে ২০১৮ সাল। চলতি বছরের শেষ প্রান্তে এসেও সিরিয়ার যুদ্ধ এবং দেশটির শরণার্থী সমস্যা অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কুশীলবদের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে এই প্রক্সিযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। তবে সিরিয়ার জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ দূত স্টিফেন মিসতারা একটি কাউন্সিল গঠনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। চলতি সপ্তাহেই এই অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের বিষয় নিয়ে এ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এক সভায় তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। ওই বৈঠকে সিরিয়ার সরকার এবং বিরোধী পক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
অতীতে যুদ্ধরত সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করা কঠিন হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক এই উদ্যোগ হচ্ছে একটি মাইলফলক এবং আশাবাদ সৃষ্টির একটি বড় কারণ। ওই বৈঠকে বিশেষভাবে সিরিয়ার কত নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে এবং কত মানুষ গৃহহারা হয়েছেন, সেটি বিবেচনায় আনা হয়েছে। অধিকন্তু প্রত্যেকেই একটি রাজনৈতিক সমাধান চান, এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। ২০১৯ সালে মনে হচ্ছে, আসতানা শান্তিপ্রক্রিয়ার গ্যারান্টার আঙ্কারা, তেহরান ও মস্কোকে আমরা আরো ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করতে দেখব। চলতি সপ্তাহেই ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের আমন্ত্রণে আঙ্কারা সফর করেন। উল্লেখ্য, রুহানি তুর্কি-ইরান সহযোগিতা পরিষদের পঞ্চম অধিবেশনে যোগদান করেন এবং ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা সম্পর্ক জোরদার করার এবং প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার উপায় নিয়ে আলোচনা করব। তিনি বলেন, ইরানের কাছে তুরস্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সিরিয়া যুদ্ধ অবসানে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে আসতানা শান্তিপ্রক্রিয়াই বাস্তব হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ এতে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যা দৃশ্যমান হয়েছে। এ জন্য আঙ্কারাকে কৃতিত্ব দিতে হবে। সাথে সাথে তেহরান ও মস্কোকেও সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে। জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে দুর্বল জেনেভা শান্তিপ্রক্রিয়ার কারণে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শুরু করা আসতানা শান্তি উদ্যোগ নিয়ে খুব বেশি কোনো আশাবাদ সৃষ্টি করা না গেলেও সহিংসতা হ্রাস করে এই শান্তিপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার পথ উন্মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রকে আশাহত ও দুর্বল করে। এ কারণে আমেরিকা চলতি সপ্তাহে সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্ক, রাশিয়া, ইরান, সিরীয় সরকার ও দায়েশের (ইসলামিক স্টেট) জন্য এটি একটি বড় বিজয়। ইসলামিক স্টেটকে এখনো সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করা যায়নি। তারা এখনো সিরিয়ার কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। আঙ্কারা যখন সিরিয়ার সেনা প্রেরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসে। আঙ্কারা কুর্দি সন্ত্রাসীদের তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের বিরুদ্ধেই তুরস্ক সেখানে সেনা পাঠাচ্ছে।
দায়েশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়াশিংটন সিরীয় কুর্দিস-পিপলস প্রটেকশন ইউনিটকে (ওয়াইপিজি) সহায়তা করায় চার বছর ধরে আঙ্কারা এবং ওয়াশিংটনের মধ্যকার সম্পর্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ওয়াশিংটন সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ওয়াশিংটন-আঙ্কারা সম্পর্কে গতিসঞ্চার হতে পারে। এ দিকে সিরীয় সীমান্তে আঙ্কারা নিজেদের শক্তিমত্তা বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে তুরস্কের বার্তা সংস্থা দেমিরোরেন (ডিএইচএ)। ইতোমধ্যে বড় বড় পিকআপ, ট্রাক ও সাঁজোয়া যানসহ প্রায় ১০০টি গাড়ি সীমান্ত এলাকার পথে রওনা হয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছে তারা।
কী কারণে এই শক্তি বৃদ্ধি তা না বললেও সিরিয়ার উত্তরে কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলে অভিযানের জন্যই এই পদক্ষেপ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। পাশাপাশি মার্কিন এই ঘোষণার কারণে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তুরস্ক সাময়িকভাবে সেনা অভিযান স্থগিত করেছে। শুক্রবার তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের এক সমাবেশ থেকে প্রেসিডেন্ট এরদোগান এ ঘোষণা দেন। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার পর সেখানে তুরস্কের অভিযান শুরু হবে বলে এরদোগান ইঙ্গিত দেন।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সিরিয়ার মাটি থেকে কুর্দি গেরিলা ও উগ্র সন্ত্রাসী আইএসের তৎপরতার অবসান ঘটানো হবে। গত সপ্তাহে সিরিয়া থেকে দুই হাজার মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তার এই ঘোষণাকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির একটি স্তম্ভের পতন হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
সমালোচকেরা বলছেন, এতে সিরিয়ায় এত বছর ধরে চলা যুদ্ধের সমাধানের পথ খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত তুরস্কের জন্য স্বস্তি বয়ে এনেছে। এতে দুই ন্যাটো মিত্রের মধ্যে টানাপড়েনের একটি কারণ সরে গেছে। এ জন্যই মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে স্বাগত জানিয়েছে আঙ্কারা।
তুর্কি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন বলেছেন, সিরিয়ায় মার্কিন উপস্থিতি তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে গেছে এবং ওই অঞ্চলে প্রক্সিযুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করেছে। তার এই অভিমতের সাথে কেউ হয়তো একমত না-ও হতে পারেন। আমরা শিগগিরই একটি নতুন বছরকে স্বাগত জানাব। এই নতুন বছরে সিরিয়ায় যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের অবসানের মাধ্যমে গোটা এলাকায় শান্তি ফিরে আসুক, এটাই সবার প্রত্যাশা। হ


আরো সংবাদ



premium cement

সকল