১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

সৌদি রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার বদলে যাবে?

-

সৌদি ভিন্ন মতের সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যা রহস্যের নাটকীয় মোড় সৌদি রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার পরিবর্তনের বিষয়টিকে জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। সৌদি বাদশাহ সালমানের আপন ভাই আহমদ বিন আবদুল আজিজ ব্রিটেন থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। মুহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স মনোনয়নের বিরোধিতাকারী এই প্রভাবশালী সৌদি প্রিন্স যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিয়েই নিজ দেশে ফিরেছেন বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। তিনি রিয়াদ ফেরার পর প্রভাবশালী সৌদি প্রিন্সরা তাকে অভ্যর্থনা জানান। সেখানে মুহাম্মদ বিন সালমানও ছিলেন। কিন্তু গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করা হয়নি।
আহমদ বিন আবদুল আজিজ হলেন, তার বাবার সুদাইরি স্ত্রীর সাত প্রভাবশালী সন্তানের একজন। সৌদি ধর্মীয় ধারার নেতৃত্বদানকারী সুদাইরি পরিবারের সদস্য এই স্ত্রীর সাথে বাদশাহ শেষ পর্যন্ত সংসার করেন। ফলে এই স্ত্রীর ঘরে বাদশাহর সর্বাধিক ১৩ জন সন্তান ছিলেন যাদের মধ্যে ফাহাদ প্রথম সৌদি বাদশাহ হন। এই পরিবারের আরো দুই সন্তান সুলতান ও নাইফ ক্রাউন প্রিন্স হলেও বাদশাহ হওয়ার আগেই তারা মৃত্যুবরণ করেন। সালমান হলেন সুদাইরি মায়ের দ্বিতীয় সন্তান যিনি সৌদি বাদশাহ হলেন।
সালমানের বাবা বাদশাহ আবদুল আজিজের দু’জন জীবিত সন্তান রয়েছেন যাদের সৌদি বাদশাহ হওয়ার জন্য উপযুক্ত মনে করা হতো। এর একজন হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ বিন আবদুল আজিজ আর অন্যজন হলেন ক্রাউন প্রিন্সের পদ ত্যাগকারী মুুকরিন বিন আবদুল আজিজ। মুহাম্মদ বিন সালমান সৌদি প্রশাসনে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ইয়েমেন যুদ্ধ শুরু করলে মুুকরিন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। আর মুহাম্মদ বিন নাইফকে ক্রাউন প্রিন্সের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে মুহাম্মদ বিন সালমানকে (এমবিএস) ক্রাউন প্রিন্সের পদে নিযুক্তির বিরোধিতা করার পর প্রভাবশালী এলিজিয়েন্স কাউন্সিল থেকে বাদ পড়ে যান আহমদ। তিনি এমবিএস ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত তার আনুগত্যের বায়াত গ্রহণ করেননি। এমনকি আহমদ তার ভাইয়ের দাফন অনুষ্ঠানে বাদশাহ আবদুল আজিজ ও বাদশাহ সালমানের ছবি রাখলেও ক্রাউন প্রিন্সের ছবি রাখেননি।
নতুন ক্রাউন প্রিন্স কাম ভাতিজা এমবিএস-এর সাথে তিক্ততা বেড়ে গেলে আহমদ বিন আবদুল আজিজ ব্রিটেনে চলে যান। সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের বেশ ক’টি পদক্ষেপ সৌদি রাজপরিবারে তীব্র ধরনের তিক্ততা ও বিভক্তি সৃষ্টি করে। এর মধ্যে ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া, লেবাবনের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে অপহরণ ও পদত্যাগে বাধ্য করা, কাতারের ওপর সর্বাত্মক অবরোধ সৃষ্টি, ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমের দাবিটি পরিত্যাগ করা, রাজপরিবারের সদস্যদের ওপর ক্র্যাকডাউন, ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক অনুশাসন পাল্টে আধুনিকতার নামে নেয়া সংস্কার এবং সর্বশেষ জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এসব ঘটনায় প্রিন্স আহমদের অবস্থান ক্রাউন প্রিন্সের কর্মকাণ্ডের সাথে মেলে না।
মুহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতা চর্চার পেছনে মূলত সক্রিয় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সমর্থন। এর বাইরে সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের সমর্থন, ধর্মীয় নেতৃত্বের সমর্থন ও সৌদি জনগণের সমর্থন রাজতন্ত্রের ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে এতদিন কাজ করে আসছিল। মুহাম্মদ বিন সালমান এ তিন ভিত্তিকে পাত্তা দিতে চাননি। তিনি দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসনকে অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সীদের নিয়ে সাজিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। এর আগে যারা সৌদি প্রশাসন পরিচালনা করেছেন বিন সালমান পর্যায়ক্রমে তাদের সবাইকে সরিয়ে দেন অথবা ক্ষমতাহীন করে ফেলেন। তিনি বাদশাহ আবদুল আজিজের পরিবারের অভিজ্ঞ সিনিয়র সদস্যের স্থলাভিষিক্ত করেন তরুণ সদস্যদের দিয়ে।
এর মধ্যে বিন সালমানের একাধিক পদক্ষেপ বিশেষভাবে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়ে দাঁড়ালে পুরো রাজপরিবারের ক্ষমতার ভিতই নড়ে যায়। ইয়েমেন যুদ্ধে পাঁচ হাজার সৌদি সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে নিহত হয় অর্ধলক্ষ ইয়েমেনি। এখন দেশটিতে চরম এক দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। ইয়েমেন থেকে ছোড়া ব্যালেস্টিক মিসাইলে আতঙ্কিত অনেক সৌদি নাগরিক। সেখানকার যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে সৌদি আরব নিজেই তহবিল সঙ্কটে রয়েছে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে জোর করে ক্ষমতাচ্যুত করতে গিয়ে দেশটি এখন অনেকটা সৌদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কাতারের ক্ষমতাসীনদের পতন ঘটাতে সর্বব্যাপী অবরোধ আরোপ এখন বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে রিয়াদের জন্য। সৌদি রাজপরিবারের কোনো সদস্যই এখন নিরাপদ মনে করছে না নিজেদের। দেশের বাইরে রিয়াদ প্রশাসনের ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারানোর আশঙ্কায় শঙ্কিত খোদ রাজপরিবারের অনেক ভিন্ন মতাবলম্বী সদস্য। সৌদি আলেম-উলামাদের দিয়ে ভরে গেছে সৌদি কারাগার। হারাম শরীফের ইমামকে জেলে ঢোকানোর ঘটনাও ঘটেছে। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে নাগরিকদের মধ্যে। এ অবস্থায় জামাল খাশোগির ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো সৌদি রাজপরিবার, উপসাগরীয় অঞ্চল এমনকি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে।
আহমদ বিন আবদুল আজিজের আলোচিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এর। তিনি ফেরার আগে রাজ পরিবারের প্রবাসী সদস্য এবং দেশে অবস্থানকারী প্রিন্সদের সাথে কথা বলেছেন। মতবিনিময় করেছেন, মার্কিন ও ব্রিটিশ ‘ডিপ স্টেট’ প্রতিনিধিদের সাথে। এক সময়ের আমেরিকান নীতিনির্ধারক সুসানা রাইসের এক লেখায় এর প্রতিধ্বনি দেখা যায়। তিনি বলেছেন, মার্কিন প্রশাসন সৌদি আরবের পরিস্থিতি নিয়ে চুপ থাকতে পারে না। সেখানে মুহাম্মদ বিন সালমানকে দিয়ে সামনে এগোনো অনেকটাই অসম্ভব যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
জার্মান প্রবাসী সৌদি প্রিন্স ফারহান বলেছেন, সৌদি রাজপরিবারের শাসন ক্ষমতাকে অব্যাহত রাখতে হলে বাদশাহ আবদুল আজিজের দুই সন্তানকে এগিয়ে আসতে হবে। এ দু’জন হলেন আহমদ বিন আবদুল আজিজ ও মুকরিন বিন আবদুল আজিজ। তাদের প্রতি সব প্রিন্সের আস্থা ও সমর্থন রয়েছে। সৌদি রাজপরিবার এখন দু’টি ধারায় বিভক্ত। একটি হলো সুদাইরি ধারা আর অন্যটি হলো আবদুল আজিজের অন্য স্ত্রীর সন্তানদের ধারা। প্রিন্স আহমদ সুদাইরি ধারা আর প্রিন্স মুকরিন অন্য ধারার প্রতিনিধি।
বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য আহমদকে বাদশাহ সালমান নতুন ক্রাউন প্রিন্স মনোনয়ন করতে পারেন বলে বলা হচ্ছে। আবার বিকল্প হিসেবে বলা হচ্ছে, আহমদ কিং মেকারের ভূমিকায় থাকবেন আর মুকরিনকে আবার উত্তরাধিকার হিসেবে নিয়ে আসবেন। সালমানের নিয়ন্ত্রণ থাকলে তিনি মুহাম্মদের স্থলে নিজের অন্য দুই ছেলের যেকোনো একজনকে ক্রাউন প্রিন্স পদে বসাতে চাইতে পারেন।
সৌদি আরবের অন্দর মহলের খবর যারা রাখেন তাদের কাছে মনে হচ্ছে দেশটির নিয়ন্ত্রণ স্থানে একটি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে। যদিও মুহাম্মদ বিন সালমান সৌদি প্রশাসনে তার নিজস্ব বলয় যেভাবে তৈরি করেছেন তাতে এ পরিবর্তন সহজ নয়। তবে তার বাইরের পৃষ্ঠপোষকরা যদি সমর্থনের হাত গুটিয়ে নেন তাহলে তিনি ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়বেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে কথা বলছেন তাতে তিনি দু’টি পথই খোলা রেখেছেন বলে মনে হচ্ছে। ট্রাম্প জামাতা জারেদ কুশনার কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছেন বন্ধু এমবিএস-এর সাথে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এমবিএস-এর পতন ঘটলে সৌদি আরবে সংস্কার কর্মসূচি অচল হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করে কিছুটা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন জায়েদ এখন অনেকটা চুপসে গেছেন।
খাশোগি হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে তারা সৌদি বাদশাহ হিসেবে এমবিএস-এর সাথে কাজ করতে পারবেন বলে মনে করছেন না। আর পাশ্চাত্যের সমর্থন উঠে গেলে রাশিয়া-চীন বলয়ে গিয়ে বিন সালমানের পক্ষে ক্ষমতাকে ধরে রাখা সহজ হবে না। সব কিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে মুহাম্মদ বিন সালমান সৌদি ক্ষমতার অক্ষ থেকে ছিটকে পড়তে পারেন। আহমদ, মুকরিন অথবা তার এমবিএস-এর ভাই যে কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। এ ছাড়া খাশোগি হত্যাকাণ্ড, ইয়েমেন যুদ্ধ, কাতারের ঘটনাসহ নানা ইস্যুতে যে ধরনের ফাঁদে সৌদি আরব আটকে গেছে তাতে এমবিএসকে বিদায় জানানো ছাড়া উত্তরণের কোনো বিকল্প এখন দেখা যাচ্ছে না। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement