২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ইমরান খানের অঙ্গীকার

-

পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে চলতি বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এ বছর যেন নির্বাচনের বছর। ইতোমধ্যে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভারতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আগামী বছর। সম্প্রতি পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে কথিত দুর্নীতির দায়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা ও কারারুদ্ধ করে অনেকটা নীলনকশার নির্বাচনের মাধ্যমে সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানকে দৃশ্যপটে নিয়ে আসা হয়েছে। ইমরান খান আগেই রাজনীতিতে এলেও পর্দার অন্তরাল থেকে এক তরফা সমর্থন না পেলে প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করতে পারতেন না। ইমরান খান দায়িত্ব গ্রহণের পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে কি কোনো গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে? ইমরান খানকে যারা ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছেÑ তিনি কি তাদের আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের কাছে একজন গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে উঠতে পারবেন? অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তান অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ইমরান খান দারিদ্র্য দূরীকরণ, দুর্নীতি নির্মূল এবং ঋণগ্রস্ত দেশকে ঋণমুক্ত ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশলী করার অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি নয়া পাকিস্তান গড়ে তুলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী কি তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সক্ষম হবেন?
ইমরান খান ’৯৬ সালে রাজনীতিতে আসেন এবং তেহরিকে ইনসাফ পার্টি গঠন করে রাজনীতিতে তার ব্যাটিং শুরু করেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল পিটিআই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়লাভ করে এবং তিনি ছোট ছোট কয়েকটি দলের সমর্থন নিয়ে কোয়ালিশিন সরকার গঠন করেন। শপথ গ্রহণ এবং নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর ইমরান অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছতা সাধনের ঘোষণা দেন।
তিনি বিশাল লটবহর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে না থাকার ঘোষণা দেন। মন্ত্রীসহ সরকারী কর্মচারীদের বিমান ভ্রমণে ব্যয় হ্রাসসহ কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যয় হ্রাসের পদক্ষেপ নেয়ার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আবার যথাসময়ে অফিসে যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। তার এসব পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা হয়। অর্থনৈতিক সংস্কারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করে। নতুন সরকার ১০০ দিনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে কৃচ্ছতা সাধন কর্মসূচির আওতায় প্রেসিডেন্ট হাউজ বা গভর্নর হাউজ ইত্যাদিকে হোটেলে রূপান্তর, সরকারি যানবাহনের নিলাম ডাক দিয়ে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। এগুলোকে পর্যবেক্ষণমহল হাস্যকর প্রচেষ্টা বলে মনে করে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে তাদের প্রতিশ্রুত অর্থসহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিছুদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তান সফরে এলেও অর্থসহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণার ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ইমরান খান দশের অর্থনৈতিক সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে প্রথম বিদেশ সফরে সৌদি আরব গেছেন। তিনি সৌদি সরকারের সহায়তায় দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। ইয়েমেনের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সৌদি আরব পাকিস্তানের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু সৌদি সহায়তায় কি পাকিস্তান তার অর্থনৈতিক সঙ্কট দূর করতে পারবে?
আমরা জানি, পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বন্ধু হচ্ছে চীন। পাকিস্তানের দুর্দিনে চীন এগিয়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। আগে থেকেই দেশটির শিল্প, বিদ্যুৎ অবকাঠামো প্রভৃতি খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে বেইজিং। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। এ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ ছয় হাজার ২০০ কোটি ডলার।
উল্লেখ্য, ’৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পাকিস্তানে চীনা বিনিয়োগ আসতে থাকে। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের আমলেই চীনের পক্ষ থেকে প্রথম বড় কোনো বিনিয়োগ আসে। আরব সাগর উপকূলের প্রাচীন গোয়াদর সমুদ্রবন্দর নতুন করে নির্মাণের জন্য ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের মধ্যে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল থেকে পাকিস্তান আগে ঋণ নিয়েছে। আর চীনের কাছ থেকে ঋণ তো আছেই।
পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছেন। পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের জন্য দরকার নতুন কর্মসংস্থান। তাকে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। দেশটির মানুষ শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় এবং জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থায় তারা আগ্রহী নয়।
আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণÑ প্রতিবেশী ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়নে ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। ইমরান খান অবশ্য জাতিসঙ্ঘের চলতি অধিবেশনের সাইডলাইনে ভারতের সাথে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু ভারত তাতে রাজি হয়নি।
এর কারণ হলো পাক-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজমান রয়েছে। কাশ্মির নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকা অবস্থায় সম্প্রতি দেশ দু’টির মধ্যে সামরিক উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার কড়া জবাব দেয়া জরুরি বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ভারতের সেনাপ্রধান। তার হুঁশিয়ারির জবাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলেছে, তারা ভারতের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।
ইমরান খান আলোচনায় বসার জন্য মোদিকে চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু সীমান্তে উত্তেজনা বিশেষত, কাশ্মিরে অসন্তোষ একটি বড় কারণ। আর আগামী বছরের প্রথম দিকে ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের সাথে আলোচনায় বসার ঝুঁকিও মনে হয় মোদি নিতে চান না। তাই ভারতের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না।
তবে উভয় ক্ষেত্রে আন্তরিক হলো ভবিষ্যতে হয়তো আলোচনায় বসা কঠিন হবে না। দুর্নীতির মূলোৎপাটন, স্বচ্ছতা এবং মানুষের মৌলিক মর্যাদা নিশ্চিত করা গেলে পাকিস্তান ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে। পরিবর্তনের অঙ্গীকার এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ইমরান খান কত দূর এগিয়ে যেতে পারবেন, তা সময়ই বলে দেবে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement