১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-মার্কিন আধিপত্যের লড়াই

-

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এতদিন বিশ্বে খবরদারি করে আসছিল। কিন্তু নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে চীন এখন বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে এখন বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে হিসাব করে চলতে হচ্ছে। আর সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হলেও ভøাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া পরাশক্তির মতোই সামরিক শক্তির দাপট নিয়ে বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে আবার নিজের শক্তিমত্তাকে জানান দিচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে খোদ নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং ন্যাটোজোটসহ মিত্র দেশগুলোর কাছেও আমেরিকার নিজের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে আমেরিকা উপমহাদেশে চীনের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াসকে নস্যাৎ করে দিতে সম্প্রতি নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে।
পাক-ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলোÑ ভারত ও পাকিস্তান। এ ছাড়াও নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ। আমেরিকা ও চীন এই দেশগুলোকে এবং বিশেষভাবে পাকিস্তান ও ভারতকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখার জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
গত কয়েক দশকে চীনের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে এশিয়ার ভূ-কৌশলগত ভূ-দৃশ্য পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলের এবং এর বাইরের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর এর প্রভাব অবশ্যাম্ভাবী। চীনের উত্থানের মধ্য দিয়েই বেশির ভাগ পরিবর্তন ঘটছে। এর আংশিক কারণ হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কার্যকর শক্তি হিসেবে আমেরিকার সামর্থ্য ও সক্ষমতা সঙ্কোচিত হয়ে আসা। ফলে চীন তার অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে ইতিহাসে অন্যান্য শক্তি যেভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিল সেভাবেই একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে।
বৃহৎ শক্তি হিসেবে একটি নতুন সমীকরণ তৈরি করতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক শৃঙ্খলা বা ভিত্তি গড়ে তোলার জন্যে চীন এখন মার্কিন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। চীনের অভিপ্রায় এখন পরিষ্কার তারা (চীন) এশিয়ার প্রধান বা মুখ্য শক্তি হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে সময় থাকলে এশিয়ার বাইরেও তার প্রভাব ছড়িয়ে দিতে চায়। তবে চীনের তৎপরতা দেখেও আমেরিকাও মনে হয় আবার নতুন করে নড়েচড়ে বসার চিন্তা করছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তারা ভারত ও পাকিস্তান সফর করেছেন।
ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দুটো দেশের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সম্প্রতি দুটো দেশই সফর করেছেন। ভারত সফরের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিসও ছিলেন। ভারত সফরের প্রধান বিষয় ছিল দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করা এবং ২০১৯ সালে যৌথ সামরিক মহড়ার ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ভারতকে স্ট্র্যাটেজিক ট্রেড অথরাইজেশন-১ (এসটিএ-১) এর মর্যাদা দিয়েছে। এই মর্যাদা দানের তাৎপর্য হচ্ছেÑ ভারতের কাছে এখন প্রতিরক্ষা ও পারমাণবিক প্রযুক্তিসহ উচ্চপ্রযুক্তি বিক্রির অনুমোদন সহজ হবে। বিশ্বের মাত্র ৩৭টি দেশকে যুক্তরাষ্ট্র এ সুবিধা দিয়ে থাকে। এশিয়ায় জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পর ভারতকে এ সুবিধা দেয়া হলো। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলেই ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা হয়। তখন ভারত-মার্কিন বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। ওবামার আমলে দুই দেশের সম্পর্ক ছিল ধীরগতির। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরো নিবিড় হয়েছে। মোদি সরকারের উৎসাহ এবং ট্রাম্পের নীতির কারণেই দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উত্থান ও প্রভাব ঠেকাতে ভারতকে কাছে পেতে চায়। আগেই উল্লেখ করেছি এশিয়ায় বিশেষত পাকিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে উদগ্রীব। এ ক্ষেত্রে ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানির ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি শিথিল করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে।
কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানের এক সময় আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকলেও এখন দুই দেশের বন্ধুত্বে অনেকটা চিড় ধরেছে। এক সময় আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া নীতিকে পাকিস্তানঘেঁষা বলে বর্ণনা করা হতো। কিন্তু এখন বাস্তবতা হলোÑ সম্পূর্ণ তার উল্টো। দুই দেশের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতির সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছেÑ পাকিস্তানকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের ৩০০ মিলিয়ন ডলার বা ৩০ কোটি ডলারের তহবিল বাতিল করে দেয়ার ঘোষণা। কোয়ালিশন সাপোর্ট ফান্ডের (সিএসএফ) আওতায় পাকিস্তানকে এ অর্থ দেয়ার কথা ছিল। সিএসএফ হচ্ছে ২০০২ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি। ওই চুক্তিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের গৃহীত ব্যবস্থা, আফগান সীমান্তে পাকিস্তানি সেনা মোতায়েন এবং আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও অভিযানের জন্য পাকিস্তানের বিভিন্ন অবকাঠামো ব্যবহারের ব্যয় হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এই অর্থ দিত। ২০০২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এর মধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলার হলো এ খাতে দেয়া অর্থ। কিন্তু গত একদশকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় পাকিস্তান যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র খুশি হতে পারেনি। বিশেষত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্য হ্রাস করার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান আফগান তালেবানদের মদদ দিচ্ছে বলে আমেরিকা অভিযোগ করে। পাকিস্তান অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ আফগানিস্তানের মার্কিন সেনাদের রসদ এবং খাবার পাঠানোর একমাত্র পথ হচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। দেশটি ঋণের ভারে জর্জরিত। তাই আর্থিক সহায়তা দরকার পাকিস্তানের। অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও পাকিস্তানের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। তবে চীনের সাথে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব আমেরিকা ভালো দৃষ্টিতে দেখছে না। চীন পাকিস্তানের দীর্ঘ দিনের বন্ধু। পাকিস্তান চীন অর্থনৈতিক করিডোর (ঘিপ্যাক) ভূ-রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের জন্য উদ্বেগজনক।
পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ইমরান খান ভারতের সাথে চির বৈরীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সম্পর্কের বরফ গলানোর ব্যাপারে আন্তরিক বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। মোদির সাথেও তিনি ফোনে কথা বলেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইসলামাবাদ সফরে গিয়ে ইমরান খান ছাড়াও দেশটির সেনাপ্রধানের সাথেও বৈঠক করেছেন।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের তিন শ’ মিলিয়ন ডলার সহায়তা বন্ধ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ সহায়তা প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে আবার চালু হতে পারে এমন ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। ইমরান খান এবং পম্পেওর মধ্যে বৈঠকে প্রধান বিষয় ছিল আফগানিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছেÑ আফগানিস্তানে শান্তি ফেরাতে এবং তালেবানের ওপর পাকিস্তান তার প্রভাবকে কাজে লাগাক। ইমরান আমেরিকার কথায় দ্বিমত করেননি। তবে তিনি জানিয়েছেন পাকিস্তান একটি সার্বভৌম দেশ, এটাও আমেরিকাকে মেনে নিয়ে পাকিস্তানের স্বার্থ অুণœ রাখার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের ভারত ও পাকিস্তান সফর নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষত, উপমহাদেশের দুটি প্রধান দেশ ভারত ও পাকিস্তানের ওপর বেশ প্রভাব ফেলবে। চীন ও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক। দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে আমেরিকা ও চীনের কর্তৃত্বের লড়াই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছে সে জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত গোয়ালন্দে প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তানকে মারধর, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন সিরিয়ায় আইএস-এর হামলায় সরকার সমর্থক ২০ সেনা সদস্য নিহত ফরিদপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু জনসমর্থনহীন সরকার জনগণের আওয়াজ নির্মমভাবে দমন করে : রিজভী

সকল