২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মধ্যপ্রাচ্যে বাড়ছে চীনের প্রভাব

চীন বাস্তবসম্মত বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে মধ্যএশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের এক সম্মিলিত সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছে -

গত ২৯ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো চীনা নেতা সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করলেন। দুই হাজার বছর আগে চীনের হ্যান শাসকদের আমলে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এবার তিন দিনের এ সফরের মধ্য দিয়ে চীনের শি জিনপিং এক নতুন অর্থনৈতিক দিগন্তের উন্মোচন করছেন সার্বিক কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে। আমিরাত বলছে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’-এর মতো ট্রিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্পে শুধু যে প্রাচীন সিল্ক রুটের পুনরুত্থান হবে তা নয় বরং এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য এক বিকল্প বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক, বন্দর, সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত হয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের জন্য চীন কতটা বুভুক্ষু তা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চেয়ে আর কে বেশি জানে! তাই আমিরাতের অপরিশোধিত তেল শিল্পে বিনা বাক্যব্যয়ে অকাতরে বিনিয়োগে মনোযোগ দিচ্ছে চীন। চীনের বিনিয়োগকারীদের আবুধাবিতে তাই অনশো’র ও অফশো’র দুই খাতেই বিনিয়োগের অনুমতি মিলেছে। ইরান ও ভেনিজুয়েলার তেল শিল্পের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ওপেকের ওপর যখন তেল উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ সৃষ্টি করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তখন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আবুধাবি থেকে অপরিশোধিত তেলের বিরাট সরবরাহ নিশ্চিত করেছেন। তেলের বাজার পড়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ দিন ধরেই অপরিশোধিত তেলের বাজারও পড়তির দিকে ছিল কিন্তু চীনে রফতানির সুযোগ ও চীনা বিনিয়োগের ফলে আমিরাত এ খাতটি এখন চাঙ্গা করার মোক্ষম সুযোগ পেল। একই সঙ্গে দি¦পক্ষীয় বাণিজ্য ইতোমধ্যে ৫৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পাশাপাশি এ দু’টি দেশ আগামী ২০২০ সালের মধ্যে তা ৮০ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ চৈনিক ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পেরই অংশ। সড়ক ও নৌপথের উন্নয়ন এ প্রকল্পে যে ৬৮টি দেশকে যে সংযুক্ত করা হচ্ছে তার একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্য দিয়েই অগ্রসর হবে। তাই আগেভাগেই শিল্প, অর্থনৈতিক, নির্মাণ অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে চীনা বিনিয়োগের এ মাহেন্দ্রক্ষণ কেন আমিরাত হাতছাড়া করতে চাইবে? বরং আমিরাত এ প্রকল্পে একটি ‘হাব’ হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এখনই মধ্যপ্রাচ্যে চীনা রফতানির ৬০ শতাংশ আমিরাত হয়েই আদান-প্রদান হয়। যার আর্থিক মূল্য ৭০ বিলিয়ন ডলার।
দ্বিতীয়ত, চীনা পণ্যের ওপর যে উচ্চহারে শুল্কারোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার মোকাবেলায় একটা বিকল্প বাজার উৎস হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যকে টার্গেট করছে চীন। আমিরাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন সেভাবেই গ্লোবাল মার্কেট থেকে একট বড় প্রবৃদ্ধি যোগানের পাকাপোক্ত ব্যবস্থাই করছে। লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, আমিরাতে ক্রমেই চীন সম্পদের ওপর বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। দুবাইতে প্রপার্টি সেলের ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে চীন। ২০১০ সালে মধ্যপ্রাচ্যে বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে চীন। শুধু অবকাঠামো খাতে চীনের বিনিয়োগ মধ্যপ্রাচ্যে দাঁড়ায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে এ ধরনের কৌশলগত বিনিয়োগ চীনের আরো বৃদ্ধি পায় সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ৩০ বিলিয়ন ডলারে।
মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিমাণ বাণিজ্য করছে চীন তার এক-চতুর্থাংশ হচ্ছে আমিরাতের মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশের সঙ্গে আমিরাতের রয়েছে চমৎকার এক স্থিতিশীল সম্পর্ক এবং দেশটির উন্নত ব্যবসায়িক পরিকাঠামোর কারণে চীনের বাজারে সহজেই অংশীদারিত্ব অর্জন করে নিচ্ছে দেশটি। আমিরাত এভাবে সহজেই অন্য আরব দেশের সঙ্গে প্রবৃদ্ধি প্রতিযোগিতায় নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারছে। একই সঙ্গে সৌদি আরব ও মিসর চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভের অংশ এবং আমিরাতের সঙ্গে দেশ দু’টির চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। আবার ইরানের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অবকাঠামো বিনিয়োগ দ্রুতই বৃদ্ধি পেয়ে তা দাঁড়িয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে। যে কারণে আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের সেতুবন্ধন হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে চীনের বিনিয়োগ প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি আমিরাতের সঙ্গে ভারতের আমদানি ও রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়ে গেছে ৫৭ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ, আমিরাত তার সবগুলো ডিম একটি ঝুড়িতে না রেখে একাধিক দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এবং তা ভূকৌশলগত ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক বটে। অন্য দিকে, ২০২৫ সালের মধ্যে চীনের নিজস্ব জ্বালানি উৎস নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই জ্বালানি কৌশলের অংশ হিসেবেই চীন মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বিশেষ কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলছে। দাকিং, শেঙ্গলি, লিয়াওহি’-এর মতো বড় ধরনের চীনা তেল ক্ষেত্রগুলো এখন তেলশূন্য পরিত্যক্ত। ব্যাপক শিল্প উৎপাদন হার অব্যাহত রাখতে নতুন জ্বালানি উৎস বা আমদানি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই চীনের হাতে। সেই ২০০০ সালেই চীনে জ্বালানি চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি শুরু হয় ২০ মিলিয়ন টন দিয়ে। ১৯৯৩ সালে প্রথম চীন জ্বালানি তেল আমদানি করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৬ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীন তেল আমদানির ৫৩ ভাগ যোগান পেতে থাকে। ১.২ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ চীনের কাছে জ্বালানি উৎস ধরে রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব তাই অনেক। শি জিনপিং’-এর আমিরাত সফরের সময় সিল্ক রোড ফান্ড থেকে ৭০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের খবর এসেছে। মোহাম্মদ বিন রাশিদ সৌরবিদ্যুতের মতো এ প্রকল্প থেকে ৭.৩০ সেন্টে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কম খরচে এ ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্প কম খরচে পানির জোগান নিশ্চিত করবে মরুভূমির দেশ আমিরাতে।
এ ছাড়া, আবুধাবি ও বেইজিং আমিরাতে চীন পর্যটকদের ভিসামুক্ত ভ্রমণে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ ও ইয়েমেন যুদ্ধে আমিরাতের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা বিনিয়োগে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের ব্যাকরণ পরিবর্তন হতে পারে। চীনের ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগ ও প্রগতিশীল মনোভাব মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। চাইনিজ একাডেমি অব দ্য সোস্যাল সায়েন্সের পরিচালক ড. ঝ্যাং বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের পাশাপাশি চীন নিজের শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রাখতে জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছে। এ উদ্যোগ ঠাণ্ডা যুদ্ধ ও উপসাগরীয় যুদ্ধের অবসানের পর নেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উত্তপ্ত অবস্থানে ছিল। দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব ছিল মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে। আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, তেল অবরোধ ইত্যাদির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কবলে পড়ে, যার রেশ এখনো কাটেনি। তবে চীন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৫৬ সালে মিসর চীনে দূতাবাস খোলে। আবার ইসরাইলে মোট বিনিয়োগের ১০ ভাগ বর্তমানে চীনা বিনিয়োগও বটে। অথচ ১৯৮৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১.৭ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় ৩.১১ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরগুলোর চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। ১৯৯৪ সাল থেকে চীন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় অর্থনৈতিক সেমিনারগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করে। বিশেষ করে, চীন অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে অস্ত্রক্রেতা দেশের নিরাপত্তা ও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশপাশি দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক না গলানোর নীতি ও এ ধরনের অস্ত্র কোনো আঞ্চলিক ভারসাম্য বিনষ্ট যাতে না করে তা নিশ্চিত করায় দেশটির গ্রহণযোগ্যতা মধ্যপ্রাচ্যে বেড়ে যায়। চীনা প্রেসিডেন্টের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে চৈনিক পাঁচ নীতিও এক্ষেত্রে বাড়তি সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে।
লক্ষ করার ব্যাপার হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান হচ্ছে চীন-সংলগ্ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত না হলে এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের উপস্থিতি চীনের কাছে চিন্তার কারণ। এ জন্য যে ১৭ মিলিয়ন মুসলিম সংখ্যালঘু দেশটিতে রয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত হলেই কেবল দেশটিতে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের জঙ্গি তৎপরতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। তাই চীন বাস্তবসম্মত বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে মধ্যএশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের এক সম্মিলিত সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছে। এসব অঞ্চলের খনিজসম্পদ উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় চীন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি দুর্নীতি, অনগ্রসরতা থাকলেও যে কৌশলগত অবস্থান ও যোগাযোগের গুরুত্ব রয়েছে তা পুরোপুরি উপলব্ধি করেই চীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এ ধরনের পরিকল্পনা এসব অঞ্চলের দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা, দারিদ্র্য দূর করতে পারলে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement