২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইউরোপে বর্ণবাদ প্রতিবাদী মেসুত ওজিল

-

ইউরোপে বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষ নতুন রূপে বিস্তার ঘটছে। অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে জার্মান ফুটবলের একটি ন্যক্কারজনক ঘটনায়। ইউরোপে বর্ণবাদের চিত্র নতুন নয়, যুগ যুগ ধরেই তারা অশ্বেতাঙ্গ ও অভিবাসীদের সাথে করে আসছে বৈষম্যমূলক আচরণ। সর্বশেষ ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছে সারা বিশ্বে। বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকেই থামিয়ে দিয়েছেন এই প্রজন্মের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন মেসুত ওজিল। জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ জেতা (২০১৪) এই তারকা বলেছেন, ‘দেশটির রাজনীতিক ও কর্মকর্তারা তার সাথে যে আচরণ করেছে, তাতে সাদা-কালো জার্সি গায়ে তোলার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছে।’ শুধু ওজিল নয়, যুগ যুগ ধরেই পশ্চিমা বিশ্বে এমন সব ঘৃণাত্মক আচরণ হয়ে আসছে এশিয়া কিংবা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ও অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি। অনেক নামীদামি ব্যক্তিত্বরাও রক্ষা পাননি এর থেকে।
বিভিন্ন কারণে কয়েক শ’ বছর আগে থেকেই ইউরোপ, আমেরিকায় অভিবাসীদের যাত্রা শুরু। কখনো তাদের নেয়া হয়েছে দাস হিসেবে, কখনো বা অর্থনৈতিক কারণে তারা পশ্চিমমুখী হয়েছেন। আটলান্টিকের দুই পাড়ে আজকের যে উন্নত সভ্যতা, তা গড়ে উঠেছে অভিবাসীদের শ্রমেই। শুধু অতীত নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বড় বড় অর্জন এসেছে অভিবাসীদের হাত ধরে। আফ্রিকান, এশিয়া কিংবা আরবÑ সব অঞ্চল থেকেই প্রচুরসংখ্যক অভিবাসীর পা পড়েছে ইউরোপ-আমেরিকায়; কিন্তু এই অভিবাসীরা কখনোই সেখানে যোগ্য সম্মান পায়নি। প্রতি পদে পদে তারা শিকার হচ্ছে বৈষম্য আর ঘৃণার। আজকের বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত আর উদার হিসেবে যারা নিজেদের দাবি করে তারাই অভিবাসীদের সাথে করে অত্যন্ত ঘৃণিত আচরণ। আটলান্টিকের দুই পাড়েই একই চিত্র। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, মার্কিন খ্যাতিমান টিভি উপস্থাপক অপরাহ উইনফ্রে, ফরাসি ফুটবলার জিনেদিন জিদান থেকে শুরু করে অনেকেই শিকার হয়েছেন বর্ণবাদের।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এশিয়া আফ্রিকার অভিবাসীদের প্রধান গন্তব্য হয় ইউরোপ। তাই অভিবাসীদের প্রতি ইউরোপীয়দের ক্ষোভটাও মার্কিনিদের চেয়ে অনেক বেশি। আবার বিভিন্ন অঞ্চলে ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক শাসনের কারণেও সেখানে গিয়েছে ওই সব দেশের লোকেরা। যেমন ফ্রান্সে প্রচুরসংখ্যক আলজেরীয় অভিবাসী; ফরাসিরা ১৩২ বছর শাসন ও শোষণ করেছে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশটি। ফ্রান্সের ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক জিনেদিনে জিদান, এবারের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক কিলিয়ান এমবাপেসহ দেশটির আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের শেকড় আলজেরিয়ায়। ইউরোপের প্রতিটি দেশেই রয়েছে এমন চিত্র; কিন্তু সর্বত্রই অভিবাসীদের দেখা হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে।
অভিবাসীদের হাত ধরে যখন কোনো সাফল্য আসে, তখন তাদের নিয়ে ঠিকই গর্ব করে শ্বেতাঙ্গরা। ইংল্যান্ডের শহর লিভারপুলের কাব ‘লিভারপুল এফসি’র হয়ে দারুণ খেলার কারণে মোহাম্মদ সালাহকে মাথায় তুলে নাচছে শহরটির মানুষ। কিছুদিন আগেও প্যারিসে একটি বাড়ির চার তলার বারান্দা থেকে ঝুলে থাকা এক শিশুকে উদ্ধার করার পর আফ্রিকান মুসলিম অভিবাসী মামুদু গাসামাকে নিয়ে কী হইচই না হয়েছে! খোদ ফরাসি প্রেসিডেন্ট দাওয়াত করেছেন ওই বীর যুবককে। অথচ কথায় কথায় ইসলাম নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলে ফ্রান্সে, পদে পদে সৃষ্টি করা হয় ধর্ম পালনের প্রতিবন্ধকতা। এরকম উদাহরণ দিলে শেষ হবে না। কিন্তু সাফল্য ধরা না দিলে, কোনো অভিবাসী বা তাদের সন্তান অন্যায় কাজ করলে দোষ চাপে সব অভিবাসীর ঘাড়ে।
জার্মানির ফুটবলার মেসুত ওজিল তার অবসর প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘দলের হয়ে ভালো খেললেই আমি জার্মান, খারাপ করলে হয়ে যাই অভিবাসী’। তুরস্কে জন্ম নেয়া ওজিল জার্মান দর্শকদের ভোটে রেকর্ড পাঁচবার দেশটির সেরা ফুটবলার নির্বাচত হয়েছেন। ২০১৪ সালে জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। অথচ খোদ ফুটবল ফেডারেশন, জাতীয়পর্যায়ের অনেক রাজনীতিক ওজিলের তুর্কি শেকড় নিয়ে অনেক বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য করেছেন। ওজিল বলেছেন, এবারের বিশ্বকাপে দল বাদ পরার পর থেকেই জার্মানির সংবাদমাধ্যম আমার তুর্কি শেকড় নিয়ে এমন সমালোচনা করেছে, যেন আমার ওই পরিচয়ের কারণেই দল প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে।
জার্মানির সাথে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ অনেক দিন থেকেই; রজব তাইয়েব এরদোগানের রাজনৈতিক উত্থান আর তুরস্কের শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে ওঠা জার্মানরা মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবেই। গত বছর তুরস্কের সংবিধান পরিবর্তন বিষয়ক গণভোটেও বিভিন্নভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে জার্মানিসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ। আর এ মানসিকতা থেকেই জার্মানির তুর্কি বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের সাথে বর্ণবাদী আচরণ করে আসছে জার্মান ফুটবল ফেডারেশন। বিশ্বকাপের আগে এরদোগানের সাথে দেখা করার কারণে ওজিল ও আরেক ফুটবলার গুনদোয়ানের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে জার্মানিতে। অথচ ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক লোথার ম্যাথিউস এবারের বিশ্বকাপের সময় ভøাদিমির পুতিনের সাথে সাাৎ করলেও সেটি নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। যদিও বর্তমানে রাশিয়ার সাথে জার্মানির সম্পর্ক খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
এটাই মুসলিম অভিবাসীদের প্রতি ইউরোপীয়দের আচরণ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিখ্যাত একজন তারকার সাথে যেখানে এমন আচরণ করা হয়, সেখানে সাধারণ অভিবাসীরা যে কতটা কষ্টে আছে তা আর বলতে হয় না। খেলাধুলাকে বলা হয় সম্প্রীতি স্থাপনের মাধ্যম, সেই খেলার মাঠেও ঘৃণা ও জাতিবিদ্বেষের নজির স্থাপন করে চলছে ইউরোপ। বেলজিয়ামের তারকা স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু বিশ্বকাপের সময় প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে লেখা এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘যখন সবকিছু ভালোভাবে হয়, পত্রিকার পাতায় আমার সম্পর্কে লেখা হয় বেলজিয়ান স্ট্রাইকার লুকাকু। আর যখন দল খারাপ করে আমি হয়ে যাই কঙ্গোর বংশোদ্ভূত লুকাকু’। ফ্রান্স ও রিয়াল মাদ্রিদের স্ট্রাইকার করিম বেনজেমাও শিকার হয়েছেন এ ধরনের আচরণের। ২০১১ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘জাতীয় দলের হয়ে গোল করলে বলা হয় আমি একজন ফরাসি, আর না পারলে তাদের কাছে আমি হয়ে যাই একজন আরব’।
২০০৬ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে জিনেদিন জিদান যে ইতালীয় ফুটবলার মাতেরাজ্জিকে মাথা দিয়ে আঘাত করেছিলেন, তার কারণও ছিল মাতেরাজ্জির ঘৃণাত্মক মন্তব্য। কয়েকদিন আগে রাশিয়ার ঘরোয়া ফুটবলে ঘটেছে ন্যক্কারজনক একটি ঘটনা। তৃতীয় স্তরের কাব টর্পেডো মস্কো কঙ্গোলিজ বংশোদ্ভূত ডিফেন্ডার ইয়োবামাকে দলে নেয়ার পর সমর্থকরা বিরোধিতা করে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে দলে নেয়ার। ফলে ওই খেলোয়াড়ের সাথে চুক্তি বাতিল করে কাবটি। যদিও ইয়োবামা রাশিয়ারই নাগরিক। ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউবে ‘রেসিজম ইন ফুটবল’ লিখে সার্চ দিলে পাওয়া যাবে ফুটবলে বর্ণবাদী আচরণের অনেক ভিডিও। এর হার ক্রমেই বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৭-১৮ ইংলিশ ফুটবলে মওসসুমে বর্ণবাদী আচরণের ঘটনা ঘটেছে ২৮২টি, ২০১২-১৩ মওসুমে যা ছিল ৫৩টি। কাজেই ইউরোপের এ চিত্র কবে পাল্টাবে, আদৌ পাল্টাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
মার্কিন লেখক ও বুদ্ধিজীবী খালেদ বেদুইন সম্প্রতি টুইটারে বলেছেন, ‘ফরাসিদের মধ্যে ভয়াবহ রকম ইসলামভীতি রয়েছে। তারা হিজাব নিষিদ্ধ করেছে, তারা মনে করে ইসলাম ফরাসি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; কিন্তু সেই মুসলিমরাই ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ এনে দিলো।’ এবারের বিশ্বকাপের ফাইনালের পরদিন ফিলিপাইনের মানবাধিকার কর্মী নরলান মার্টিনেজ এক টুইটারে বলেছেন, ‘প্রিয় ফ্রান্স, তোমাদের দলের বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ, আর অনেকেই মুসলিম, যারা তোমাদের দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ এনে দিলো। এবার দয়া করে বর্ণবাদ, ইসলামবিদ্বেষ বন্ধ করো। তোমাদের বিজয় স্পষ্টতই সারা বিশ্বের অভিবাসীদের বিজয়। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement