২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দুই গোয়েন্দা প্রধানের মুখোমুখি আইএসআই বনাম র’

-

প্রকাশের পরই আলোড়ন তুলেছে ‘স্পাই ক্রনিকলস: র, আইএসআই অ্যান্ড দ্য ইলুশন অব পিস’ বইটি। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (জঅড) সাবেক প্রধান এ এস দুলাত ও পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (ওঝও) সাবেক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অব: আসাদ দুররানির সাথে ভারতীয় সাংবাদিক আদিত্য সিনহার আড্ডায় উঠে আসা কথোপকথনগুলো তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। বইটি প্রকাশের জন্য দুই দেশের সাবেক দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে নিয়ে ইস্তাম্বুল, ব্যাংককসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েক দফা আড্ডা দিয়েছেন আদিত্য সিনহা। দুই বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক ঝড় তুলেছে বইটি। দেশ-মহাদেশের পাঠকদের জন্য
বইয়ের একটি অংশ অনুবাদ করেছেন আহমেদ বায়েজীদ

আদিত্য সিনহা : অনেকেই বলে যে আইএসআই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র।
আসাদ দুররানি : অনেক দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকেই এই নামে ডাকা হয়। সিআইএ, কেজিবি। এই কথাটির মাধ্যমে মূলত একটি দেশের অভ্যন্তরের শক্তিশালী একটি গোষ্ঠীকে বোঝানো হয়, যারা পর্দার অন্তরালে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। এর দ্বারা বোঝানো হয় যে, এরা অদৃশ্য তবে প্রভাবশালী। আমার ভাষায় এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, এক ধরনের ভণ্ডামিও। যুক্তরাষ্ট্রেরও একটি এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিশাল তহবিল, সামিরক-শিল্প ও ইহুদি লবিং নিয়ন্ত্রণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র কাঠামোটি এমনকি প্রেসিডেন্টের নীতিও প্রভাবিত করে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আফগান ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টার সময় আমরা সেটি দেখতে পেয়েছি। সিআইএ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন ও সামরিক শিল্প রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অসহায় করে তোলে। এটা যে পাকিস্তান বলে তা নয়, সাবেক সিআইএ প্রধানসহ অনেক মার্কিন নাগরিকের বক্তব্য এটি। সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে এই সংস্থাগুলো যেটিকে উপযুক্ত মনে করে সেটাই করে। সিআইএ এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জীবনকেও দুর্বিষহ করে তুলেছে। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বাধা ও বিদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করার তার যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল তাও পূরণ করতে দিচ্ছে না।
সিনহা : আইএসআই কি বিন লাদেনকে লুকিয়ে রাখেনি?
দুররানি : একটি টিভি চ্যানেলে এ বিষয়ে আমি আমার মূল্যায়ন নিয়ে কথা বলেছি। (তার লুকিয়ে থাকার বিষয়ে) কিছু তথ্য আমরা জানতাম। একটা পর্যায়ে আইএসআই সম্ভবত বিষয়টি জেনেছে এবং পারস্পারিক সমঝোতার ভিত্তিতে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছে। অথবা সম্ভবত আমরাই যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছি একে নিয়ে যাও, অথবা বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করেছি। আমাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না সে কথা বললে, এড়িয়ে যাওয়া হবে। পাকিস্তানের অনেক মানুষ যাকে ‘বীর’ হিসেবে দেখে এমন একজনকে গ্রেফতার করতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার বিষয়টি পাকিস্তান সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারত। (সে কারণেই হয়তো না জানার ভান করেছে)
এ এস দৌতল : আমাদের মূল্যায়নও একই। আমরা মনে করি পাকিস্তান বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছে।
দুররানি : আপনাদের এই ভাবনাটি আমাদের জন্য অস্বস্তিকর।
দুলাত : দেখুন, ভারতে সামরিক-শিল্প (সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা খাতের মধ্যে সমন্বয়) কথাটির সাথে আমরা এই কয়েক বছর আগ পর্যন্তও পরিচিত ছিলাম না। অথচ এটি ক্রমশই শক্তিশালী একটি বিষয় হয়ে উঠেছে। আইএসআই একটি অনেক বড় সংগঠন, নতুবা ভারতে প্রতিদিন এটির নাম নেয়া হতো না। ভারতে যাই ঘটুক, তার জন্য আইএসআইকে দোষারোপ করা হয়। এটিকে রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাষ্ট্র বললে সেটি অনেক কার্যকর মনে হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্যও এটি একটি উত্তেজনাকর বিষয়।
সিনহা : কিন্তু ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর আইএসআই টার্মটির ব্যবহার কমে এসেছে। এখন সব কিছুর জন্য দায়ী করা হয় উদারপন্থী ও বুদ্ধিজীবীদের।
দুলাত : একবার করাচিতে একটি টিভি চ্যানেল আমাকে প্রশ্ন করেছিল- আইএসআই সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আমি বলেছিলাম, সংস্থাটির প্রধান হতে পারলে আমি গর্ববোধ করতাম!
আদিত্য সিনহা : আইএসআই ও র- এ দুটোর মধ্যে কোনটি সেরা।
দুলাত : র’য়ের সাথে আইএসআইয়ের তুলনা করা ঠিক নয়। কারণ, আইএসআই অনেক পুরনো সংস্থা। র’য়ের বয়স এখনো পঞ্চাশ বছরও হয়নি। ১৯৬৮ সালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) একটি অংশ আলাদা করে র’ গঠন করা হয়। সম্ভবত ১৯৬২ ও ১৯৬৫ যুদ্ধের গোয়েন্দা ব্যর্থতার পর এটি করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্ব ও এর অভাব টের পেয়েছিলেন।
দুররানি : একবার একটি সম্মেলনে এক মার্কিন সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কিভাবে র’কে মূল্যায়ন করেন? এটি কোনো সাধারণ প্রশ্ন ছিল না, প্রশ্নটির উদ্দেশ্য ছিল আমি যাতে র’কে নিয়ে বিশ্লেষণী কথা বলি সেটিতে উদ্বুদ্ধ করা। ওই সাংবাদিক হয়তো আমার কাছ থেকে উত্তর পেয়ে র’ প্রধানের কাছে গিয়ে বলতেন, দেখুন আইএসআই প্রধান কী বলছেন আপনাদের সম্পর্কে। এরপর তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইতেন। তো তাকে আমি বলেছিলাম, ‘আইএসআইএর মতোই’।
আমি দায়িত্ব নেয়ার আগেই আইএসআই আফগানিস্তান অপারেশনে যুক্ত হয়েছিল। আমি দেখলাম সবাই বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছে। সবাই বলতে লাগল যে, আইএসআই শক্তিশালী একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছে, তারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। (ভারতীয় টিভি উপস্থাপক) রবি দুবির অনুষ্ঠানে একবার এক অতিথি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আইএসআই-এর কর্মকাণ্ডের প্রধান ফোকাস কী? ওই সময় আমাদের প্রধান ফোকাস ছিল অবশ্যই আফগানিস্তান। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল তাদেরকে চিন্তায় রাখা তাই বললাম, ‘অবশ্যই ভারত’।
দুলাত : আমি জেনারেল সাহেবের সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, আইএসআই কিংবা অন্য পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিপরীতে ভারতীয় র কিংবা আইবি যথেষ্ট পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করে চলছে। আমাদের সংস্থাগুলো এমন অনেক কাজ করেছে যা সাধারণ মানুষ জানে না বা তাদের জানা উচিতও নয়। গোয়েন্দা জগতে ভারত এমন কিছু নাম তৈরি করেছে যা সারা বিশ্বেই আলোচিত, যেমন বি এন মল্লিক, আর এন কাও, এ কে নারায়ণ এবং সাম্প্রতিক সময়ে অজিত দোভাল।
দুররানি : প্রায় বছর দশেক আগে স্মাশিং নামের একটি ওয়েবসাইট বিশ্বের সেরা দশটি গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা তৈরি করেছিল। অপ্রত্যাশিতভাবেই সেই তালিকার শীর্ষে ছিল আইএসআই। এর পর যথাক্রমে ছিলÑ মোসাদ, সিআইএ ও অন্যান্য সংস্থাগুলো।
সিনহা : ভারতের বিরুদ্ধে আইএসআইয়ের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা কোনটি? একই প্রশ্ন আমি তাকেও (দুলাত) করব।
দুররানি : আমার বন্ধুর আগে জবাব দেয়া উচিত।
দুলাত : পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো আমরা কোনো আইএসআই অফিসারকে আমাদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারিনি। অথবা এমন কিছু হলেও আমার জানা নেই। আপনি যদি স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের দিকে তাকান দেখবেন, সিআইএ কর্মকর্তাদের প্রধান কাজ ছিল পক্ষত্যাগী কিংবা শত্রুপক্ষের হয়ে কাজ করছে এমন লোকদের খুঁজে বের করা। কোনো সিআইএ অফিসার এমন কোনো লোককে ধরিয়ে দিতে পারলে সারা জীবন তাকে আর কোনো কাজ না করলেও চলত। কারণ, এটিই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। এই বিষয়টি আমরা সঠিকভাবে ভাবতে পরিনি এবং আমি মনে করি আমরা এতে সফলও হতে পারিনি।
সিনহা : এমনও হতে পারে আইএসআইয়ের ভেতর র’য়ের সোর্স আছে, কেউ জানে না।
দুলাত : সোর্স তৈরি করা পক্ষত্যাগী লোক তৈরি করার চেয়ে অনেক সহজ। জেনারেল সাহেব ডাবল এজেন্টের বিষয়ে কথা বলেছেন। পক্ষত্যাগীর পর দ্বিতীয় সেরা সম্পদ হচ্ছে ডাবল এজেন্ট। কাজেই আইএসআইয়ের কোনো অফিসারকে পক্ষত্যাগ করাতে না পারা আমদের বড় ব্যর্থতা।
দুররানি : ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ময়দানে আমরা ওপার থেকে যথেষ্ট তথ্য পেয়েছি। আর ১৯৭১-এর যুদ্ধে আইএসআই পূর্ব পাকিস্তানে হামলার বিষয়টি আঁচ করতে পারেনি। আমার সময়ে কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের সামরিক আয়োজন দেখে আমরা বুঝেছি এগুলো যুদ্ধের প্রস্তুতি নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিলÑ কাশ্মির উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও আমরা বুঝতে পারিনি একটি কতদূর যাবে।
সিনহা : ইসলামাবাদের কর্মকর্তাদের কাজ কি দিল্লিতে আইএসআই কর্মকর্তার কাজের চেয়ে কঠিন?
দুররানি : আমি জানি না। আমার সময়ে যদিও তখন কাশ্মির উত্তপ্ত ছিল, আমি মনে করি না ওই পক্ষ থেকে কোনো অস্বাভাবিক অভিযোগ ছিল। তবে আমি বিষয়টি বুঝতে পেরেছি তারা যখন ‘তাদের সরকার কেন প্রতিপক্ষের চেয়ে কঠিন নয়’ বলে প্রতিবাদ করেছে।
দুলাত : স্যার ঠিক বলেছেন। পরবর্তীতে এটি আর ঘটেনি। তবে কয়েক বছর আগেও পাকিস্তানে আমাদের কর্মকর্তাদের খুব বাজে সময় কাটত।
সিনহা : সংস্থা দু’টি কিভাবে মিডিয়াকে ব্যবহার করে?
দুররানি : মিডিয়া যুদ্ধ চলছেই দুই পক্ষের মধ্যে। এমনকি তারা টিভি চ্যানেলেও বিনিয়োগ করে, নিজেদের পক্ষে কাজ করবে এই আশায়। তাদের ধারণা নেই এই বিষয়টিকে কিভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত। এরকম প্রথম চ্যানেলটি ছিল ভারতীয়। তাদের টাকা দেয়া হয়।
দুলাত : কারা টাকা দিয়েছে? আইএসআই?
দুররানি : না, আইএসআই এই অঙ্গনে আরো পরে এসেছে।
দুলাত : তাহলে আপনি বলছেন একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে বিনিয়োগ করেছে ভারতেরই একটি সংস্থা।
দুররানি : র- করেছে এটি। যতটা মনে পড়ছে আড়াই কোটি মার্কিন ডলার ছিল। ওই সময় সেটি ছিল বড় একটি অঙ্ক।
সিনহা : আজকের দিনেও কম বড় নয়।
দুলাত : কী জন্য ছিল সেই বিনিয়োগ? কখনো শুনিনি।
দুররানি : র’য়ের পক্ষে কাজ করার জন্য টিভি চ্যানেল খুলতে। গোয়েন্দা জগতের সবাই বিশ্বাস করে যে, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জিততে হলে মিডিয়ায় বিনিয়োগ করতে হবে।
এই জায়গাটিতে আমাদের দেশ খুব বেশি অগ্রসর নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। যুদ্ধের সময় পরিবেশ তৈরি করে। মিডিয়াকে ব্যবহার করে এটি করা হয়। 


আরো সংবাদ



premium cement