২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুরে বাজার সয়লাব

মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুরে বাজার সয়লাব - সংগৃহীত

মাহে রমজানকে সামনে রেখে বাজারে প্রবেশ করছে পচা ও মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর। প্রশাসনের নাকের ডগায় এই হীন কাজটি করে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ধর্মপ্রাণ সিয়াম সাধকরা। ইতোমধ্যে কয়েক শ' কোটি টাকার কয়েক বছরের পুরনোসহ পচা ও কেমিক্যাল যুক্ত খেজুর জব্দ করেছে র‌্যাব ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তবে এসব অভিযান প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে মনে করছেন ভোক্তা সাধারণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত খেজুরের এলসি খোলা হয়েছে ২৩ হাজার ৪১২ টন। একই সময়ে ১৩ হাজার ৪৪৫ টন খেজুরের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে খেজুরের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ যথাক্রমে ২৯ হাজার ৪৫২ ও ২৪ হাজার ৯৪৫ টন। সে হিসাবে খেজুরের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমেছে ৬ হাজার ৪০ ও ১১ হাজার ৫০০ টন।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রোজার মাসে চাহিদার পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার টন। এখন পর্যন্ত দেশে খেজুর আমদানিতে যে পরিমাণ এলসি খোলা হয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। তাতে নষ্ট ও মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুরে তেল মাখিয়ে কিংবা পুরনো মোড়ক পাল্টিয়ে নতুন মোড়কে বাজারজাত করছে ব্যবসায়ীরা।
আর বাজারে প্যাকেটজাত খেজুর ছাড়া কোনো খেজুরেই প্রক্রিয়াজাত ও ব্যবহারের মেয়াদকাল উল্লেখ নেই। অন্যদিকে খোলা বাজারে বিক্রি হওয়া খেজুরের মেয়াদকাল ঠিক কবে শেষ হয়েছে তা জানাই মুশকিল হয়ে পড়ে ভোক্তাদের কাছে।

বাজারে বিদ্যমান খেজুরের ‘সাধারণ মান’সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণাই দিতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত পণ্য বিপণনকারী সংস্থা টিসিবি।
রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, পুরানা পল্টন, নয়া পল্টন, কাকরাইল, নিউ মার্কেট, চকবাজার, মৌলবি বাজার, মহাখালি, মিরপুর থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার বাজারগুলোতেও দেখা যায়, বিনা বাধাঁয় খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ খেঁজুর। যাতে ক্রেতা-বিক্রেতা বা সরকারি খাদ্য মাননিয়ন্ত্রক সংস্থার কোন নজরদারিই নেই। খোলাবাজারে এসব খেজুরের ক্রেতা-ভোক্তাদের মধ্যেও দেখা যায় মান নিয়ে এক প্রকার উদাসীনতা।

আর বিএসটিআই এর বাধ্যতামূলক মান যাচাই তালিকায় আমদানিকৃত খেজুর না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর বাদামতলির একজন আমদানি কারক সাথে কথা হলে সে জানায়, দেশে সাধারণত খেজুর সৌদি আরব, দুবাই, তিউনিশিয়া, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, মিসর ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। সাধারণত মিয়ানমানের খেজুর রফতানি করা হয় ইরাক থেকে। অন্যান্য খেজুরের মধ্যে সৌদি ২৫০ টাকা, মরিয়ম-প্রিমিয়াম ৩৬০ টাকা, কমলী (দুবাই) ৩০০ টাকা, ফরিদা (তিউনিশিয়া) ২২০ টাকা, বরই খেজুর (সৌদি আরব) ২০০ টাকা, কাচা খেজুর (দুবাই) ৭০০ টাকা, মদিনা খেজুর ২০০ টাকা এবং খোরমা ১৫০ টাকায় প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর একজন আমদানিকারক জানান, প্রতি বছর খেজুর আমদানির বড় একটি পরিমাণ অবিক্রিত থেকে যায়। এসব খেজুর তাদের সারা বছর বিক্রি করতে হয়। আর যেসব খোলা খেজুর আমদানি করা হয় তা প্রকৃতপক্ষে মানহীন। প্যাকেটজাত উন্নত মানের খেজুরের মেয়াদ থাকে মাত্র তিন মাস। কিন্ত সেই তিন মাসে অনেক ক্ষেত্রে গোডাউনেই শেষ হয়ে যায়। তাতে তারা বড় ধরণের লোকসানের আশঙ্কা থাকে। এ থেকে বাঁচতে নতুন মোড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ ওসব খেজুর বাজারজাত করেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত বাদামতলী থেকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাসহ দক্ষিণ অঞ্চলে খেজুরসহ বিভিন্ন ফল নেন পাইকারি- খুচরা ব্যবসায়ীরা। বাদামতলীতে খেজুরের ব্যবসায়ী (আড়তদার) ৪০ থেকে ৪৫ জন। বাজারে খেজুরের সরবরাহ কত হবে এবং দাম কেমন হবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করে তাদের ওপর।

জানা যায়, বাদামতলীর এস এম এন্টারপ্রাইজের সিরাজুল ইসলাম, তানভীর এন্টারপ্রাইজের রাসেল হোসেন, খাজা ফ্রুটের হাজি বয়রাত হোসেন, আল্লাহর দানের মালিক হাজি আফসার আলী, শাকিল ফ্রুটসের মালিক হাজি শামসু হাওলাদার, জিল্লুর এন্টারপ্রাইজের জিল্লুর রহমান, নাবিল এন্টারপ্রাইজের হাজি মনির হোসেন, মদিনা ফ্রুটের মালিক সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম, বাগদাদ ও জয়া এন্টারপ্রাইজের হাজি সাজাহান খেজুর আমদানি করেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে বাড়িয়ে দেন খেজুরের বাজার মূল্য। আবার নতুন মোড়কে পুরনো খেজুর বাজারজাত করার হোতাও এদের অনেকেই।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম লস্কর জানান, আমরা র‌্যাবকে সাথে নিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বাজারজাতকারীদের বিরোদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। এছাড়া প্রতিটি জেলা পর্যায়ে কমিটি করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। রমজানে আমাদের অভিযান আরো জোরালো হবে। যেসব আমদানিকারক নষ্ট ও মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর বাজারজাত করছে তাদের বিরোদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কোন অসাধু ব্যবসায়ীর পাড় পাওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর ডা. জিয়াউল হক বলেন, পচা ও মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর খেলে প্রথমে ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে। এরপর দীর্ঘমেয়াদি জন্ডিস, লিভার ও খাদ্যনালিতে ক্যান্সার হতে পারে।

ক্রেতা সাধারণ মনে করছেন, অধিক লাভ আর মুনাফার অসাধু ব্যবসায়িরা মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর বাজারজাত করছে। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বড় রকমের হুমকি। তাই সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও এগিয়ে আসতে হবে। এখন তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযান তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এই অভিযান আরো জোরালো করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement