২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ছাত্রী আত্মহত্যায় প্ররোচণা : শিক্ষিকা গ্রেফতার

ছাত্রী আত্মহত্যায় প্ররোচণা : শিক্ষিকা গ্রেফতার - ছবি : সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকায় এক কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনা এবং আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে এক শিক্ষিকাকে গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

গত মঙ্গলবার সুমাইয়া আক্তার মালিহা নামে ১৪ বছর বয়সী ওই কিশোরী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। কিশোরীটির পরিবার বলছে, ঘটনার দিন মালিহা স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যায় নিজের কক্ষে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও দরজা না খোলায় পরিবারের সন্দেহ হয়। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা খোলায় তারা থানায় খবর দেয়।

পরে রাত সোয়া নয়টার দিকে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে মালিহার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে।

এ বিষয়ে শাহজাহানপুর থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানান, "পরিবারের খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থলের সুরতহাল শেষে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠান।"

সে সময় মালিহার স্কুলব্যাগ থেকে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে শাহজাহানপুর থানা পুলিশ।

নোটটিতে স্কুলের এক শিক্ষিকার দুর্ব্যবহারে মানসিক চাপের কারণে মালিহা আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়।

পুলিশ বলছে, চিরকুটটি মালিহার লেখা কিনা সেটা নিশ্চিত হতে সেটা বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে পরিবারের দাবি, সেটা মালিহার হাতের লেখা। লেখাগুলো স্কুলের খাতার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া হয়েছে।

মালিহার মামাতো ভাই ইসমাইল খান জানান, দশ বারো দিন আগে স্কুলে পরীক্ষার সময় সেখানকার এক শিক্ষিকা, মালিহার পরীক্ষার খাতা কেড়ে নিয়ে নম্বর কম দেন।

স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে মালিহা এ বিষয়ে মৌখিক অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন মিস্টার খান।

তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করায় ওই শিক্ষিকা ক্ষিপ্ত হয়ে মালিহার খাতায় নম্বর কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ক্লাসে খারাপ ব্যবহার করে। এ নিয়ে মালিহা মানসিক চাপে ভুগছিলেন বলে জানান তার মামাতো ভাই। তবে এমন কোনো অভিযোগ আসেনি বলে দাবি করেছেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক।

পুলিশ বলছে. সুইসাইড নোটটিতে ওই শিক্ষিকাকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। সেখানে লেখা ছিল, ওই শিক্ষিকা তার জেদ কমানোর জন্য পরীক্ষার খাতা টেনে নিয়েছেন, পরীক্ষা কম নম্বর দিয়েছেন। ম্যাডামের অভিশাপে তার ভালো রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।

চিঠির শেষের দিকে ওই শিক্ষিকার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়।

এই সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে এরইমধ্যে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন ছাত্রীর বাবা মোহাম্মদ আলী।

মামলার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বুধবার তাকে আদালতে নেয়ার পর আদালত তার এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বর্তমানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মালিহার মামাতো ভাই ইসমাইল খান অভিযোগ করে বলেন, ওই স্কুল শিক্ষিকা তার কাছে কোচিং না করলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। তবে মালিহাকে বকাঝকা করতেন সবচেয়ে বেশি।

এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "অভিযুক্ত শিক্ষক তার জানা মতে কোনো কোচিং করাতেন না।

তবে স্কুলের অনেক শিক্ষক প্রাইভেট কোচিং করান উল্লেখ করে তিনি বলেন, "স্কুল থেকে নির্দেশনা দেয়া আছে, কেউ চাইলে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। কিন্তু কাউকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য কোনো ধরণের চাপ দেয়া যাবে না।"

স্কুলের একজন ছাত্রীর এমন মৃত্যুর ঘটনায় অন্য শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান হোসেন। তিনি বলেন, এরইমধ্যে তারা শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং দেয়া শুরু করেছেন। সেখানে তাদের জীবন, দর্শন সহমর্মিতা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ধারণা দেয়া হচ্ছে।"

এছাড়া কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যদি এ ধরণের অভিযোগ ওঠে তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ সতর্কমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এ ধরণের ঘটনা ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরো কঠোর মনিটরিংয়ের প্রয়োজন বলে জানান রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, "কিশোর বয়সী একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কি ধরণের আচরণ করা উচিত সে বিষয়ে সচেতনতার প্রয়োজন।"

এ বিষয়ক একটি বিধিমালা প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রজ্ঞাপন আকারে ঝুলিয়ে রাখার ব্যাপারে তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিলেও সে বিষয়ে কোন সাড়া মেলেনি বলে জানান।

এক্ষেত্রে পারিবারিক অসচেতনতাকেও দায়ী করেন তিনি।

ফিজিক্যাল এন্ড হিউমিলিয়েটিং পানিশমেন্ট-পিএইচপি অর্থাৎ শারীরিক ও অবমাননাকর শাস্তির বিষয়ে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ৮৬% শতাংশ অভিভাবক স্কুলে শাস্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। চলতি বছর সেই হার কমে ৫৬ শতাংশতে দাঁড়িয়েছে।

তবে এটাও যথেষ্ট নয় বলে উল্লেখ করেন চৌধুরী।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করণীয় :
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তিনটি উপায়ের কথা তুলে ধরেন তিনি।

প্রথমত, এ সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনার বিষয়ে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি স্কুলে সচেতনতা অভিযান পরিচালনা।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রজ্ঞাপন আকারে জনসম্মুখে ঝুলিয়ে দেয়া যেন শিক্ষক শিক্ষার্থীরা তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আইনের ব্যাপারে ধারণা পায়।

তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকার ও কমিউনিটির উচিত এ ধরণের ঘটনা ধামাচাপা না দিয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। এবং স্থানীয় প্রশাসন বা সালিশের মাধ্যমে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।


আরো সংবাদ



premium cement