যেভাবে লেগ স্পিন শিখলেন রশিদ খান
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২১ এপ্রিল ২০১৯, ০৫:৫৫
পূর্ব আফগানিস্তানের নানগরহার। যেখানে ব্যাটের সঙ্গে বলের মিলনের মিষ্টি শব্দ শোনার কোনো সুযোগ ছিল না। থাকত শুধু বাতাস কাঁপানো বিস্ফোরণ আর গোলাগুলির আওয়াজ। যেখানে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প করার সাহস কারো হতো না, চলত বন্দুকধারীদের শিবির। এমনই এক যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে আতঙ্কের প্রহর পেরিয়ে তিনি এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে বন্দিত নায়ক। ক্রিকেটের ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’ কাহিনী তিনি। কেকেআর এবং আন্দ্রে ‘মাসল’ রাসেলের মুখোমুখি হওয়ার আগের দিন আফগান লেগস্পিনার রশিদ খান হায়দরাবাদ থেকে ফোনে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন। এখানে তা তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আফগানিস্তানের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে আন্তর্জাতিক নায়ক। কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন এই যাত্রাকে?
রশিদ খান : খুবই স্মরণীয় যাত্রা। আফগানিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারা বিশাল প্রাপ্তি। সেখানে আমি আফগানিস্তানের মুখ হয়ে আইপিএলেও খেলছি। একটা স্বপ্নপূরণের মতো ব্যাপার। টি-টোয়েন্টিতে এক নম্বর বোলার হওয়া, ওয়ান ডে-তে দু’নম্বর বোলার, আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর অলরাউন্ডার হওয়া। কখনো কখনো মনে হয়, ঘোরের মধ্যে আছি।
প্র : আফগান ক্রিকেটের মুখ আপনি। নানা সমস্যায় আক্রান্ত একটা দেশের এত মানুষের সামনে উদাহরণ হতে পারার অনুভূতি কেমন?
রশিদ : নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। যখন শুনি, আমাকে দেখে দেশের অনেক ছেলে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছে, অনেকে ক্রিকেট দেখতে শুরু করেছে বা অনেকে খেলাটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে, মনে হয়, সেটাই সেরা প্রাপ্তি। আমার নামের পাশে ক’টা উইকেট বা কত রান লেখা থাকল, তার চেয়েও এটা বেশি আনন্দ দেয়। ক্রিকেট খেলার রাস্তায় আমরা সকলেই কিছু না কিছু উইকেট তুলব, কয়েক হাজার রান করব কিন্তু বৃহত্তর সমাজে যদি প্রভাব রেখে যেতে পারি, সেটা অনেক বেশি তৃপ্তিদায়ক।
প্র : শোনা যায় কোনও এক রশিদ খানের সাফল্য আফগানিস্তানের ছবিটাই অনেক পাল্টে দিয়েছে?
রশিদ : জানি না, রশিদ খানের জন্য হয়েছে কি না। তবে এটা ঠিক যে, এখন সম্পূর্ণ অন্য আফগানিস্তান দেখতে পাওয়া যাবে। দেশের কিশোর, তরুণরা ক্রিকেট খেলতে চাইছে। ক্রিকেট এখন আফগানিস্তানের মানুষের হৃদয়ে। আইপিএল ভীষণ জনপ্রিয় আমাদের দেশে। আফগানিস্তানের কিশোর প্রতিভারা স্বপ্ন দেখে আইপিএল খেলার। নিজেকে খুব আশীর্বাদধন্য মনে হয় যখন দেখি দেশের কিশোররা আমাকে ভালোবাসে, আমার মতো হতে চাইছে। এটাই তো সেরা পুরস্কার!
প্র : টি-টোয়েন্টি নির্মম সব ব্যাটসম্যানের খেলা। এর মধ্যে লেগস্পিনার রশিদ খান কী করে বছরের পর বছর সফল হচ্ছে?
রশিদ : আমার মনে হয়, অন্য লেগস্পিনারদের চেয়ে আমি একটু আলাদা। আমার অ্যাকশনটাও আলাদা। একটু দ্রুতগতিতে আমার হাতটা ঘোরে। সেই কারণে মনে হয় ব্যাটসম্যানেরা আমাকে বুঝতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। আমার কিন্তু দর্শনটা হচ্ছে, মাঠে গিয়ে খেলাটা উপভোগ করো। বেশি আগে বা পরের ঘটনা নিয়ে আমি ভাবি না। আরো একটা কথা বলতে চাই। লেগস্পিন আর গুগলি বোলিংটা আমার মধ্যে খুব সহজাত ভাবে এসেছে। সেই সহজাত ভাবটাকে আমি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে গিয়েছি। শাহিদ আফ্রিদি আর অনিল কুম্বলেকে দেখে আমি সব চেয়ে বেশি শেখার চেষ্টা করেছি। ওদের দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে, বোলিং হচ্ছে আসলে একটা ‘এনজয়মেন্ট’। আমিও বোলিং উপভোগ করার চেষ্টা করি।
প্র : পরের প্রতিপক্ষ আন্দ্রে রাসেল। যার ধুন্ধুমার ব্যাটিং দেখে বিস্মিত ক্রিকেট বিশ্ব। কী ভাবে তৈরি হচ্ছেন?
রশিদ : আন্দ্রে রাসেল এই মুহূর্তে সত্যিই সংহারকের মেজাজে রয়েছে। যে ভাবে সব বলই গ্যালারিতে উড়িয়ে দিচ্ছে, অবিশ্বাস্য! যেকোনো বোলারকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে ও। রোববার একটা বড় ম্যাচ, বড় পরীক্ষা, সন্দেহ নেই। আমি ব্যাপারটাকে সহজ, সরল রাখার চেষ্টা করছি। অতীতে কী ধরনের বল করে ওর বিরুদ্ধে সাফল্য পেয়েছি, তা মাথায় রাখার চেষ্টা করব। রাসেল যখন আক্রমণ করবে, তখনও আমি নিজের সেরা ডেলিভারিগুলো করে যাওয়ার চেষ্টা করব।
প্র : রাসেলের মতো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানকে বল করার সময় সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কী?
রশিদ : ইতিবাচক থাকা। নিজের প্রতি বিশ্বাস না হারানো। আর নিজের সেরা বলটা করে যাওয়া।
প্র : অভিজ্ঞতা কাজে আসতে পারে?
রশিদ : অবশ্যই। হায়দরাবাদের এই মাঠে আমি প্রচুর ম্যাচ খেলেছি। স্পিনার যদি বুদ্ধি করে বল করতে পারে, যদি বৈচিত্র মেশাতে পারে, ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ হবে না। রাসেলকে কিন্তু আমি তিন বার আউটও করেছি। আমারও জানা আছে, ঠিক কী ধরনের বল করতে হবে। কোন ধরনের ডেলিভারির সামনে ও অস্বস্তিতে থাকে।
প্র : রাসেলের মতো পাওয়ারহিটারকে বল করার পরিকল্পনা কী হতে পারে?
রশিদ : টি-টোয়েন্টিতে এমন রাত আসেই যখন ব্যাটসম্যান সম্পূর্ণ বিধ্বংসী মেজাজে রয়েছে। সামনে যা-ই বল আসুক, সে উড়িয়ে দিচ্ছে। সেই সময় বোলার হিসেবে একটাই কাজ করতে হবে। বিশ্বাস না হারিয়ে সেরা বলটা করে যাও। নিশানায় অভ্রান্ত থাকো। আলগা কোনো বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারি দেয়া যাবে না। আমি বোলার হিসেবে সেরা বলটা করে যাব। তার পর পাওয়াহিটার যদি মেরে নিতে পারে তো নিক! টি-টোয়েন্টির লড়াইয়ে স্পিনারদের মানসিক গঠন ঠিক রাখা খুব জরুরি। কার গায়ে প্রচুর শক্তি আর কে কত বড় পাওয়ারহিটার, তা আমি ভাবতে যাব কেন? আমি ইতিবাচক থাকব।
প্র : সানরাইজার্স দলে মেন্টর হিসেবে রয়েছেন মুথাইয়া মুরলীধরন। তার কাছ থেকে কী উপদেশ পাচ্ছেন?
রশিদ : নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় যে, এ রকম একটা দলের সঙ্গে আমি থাকতে পারছি। দারুণ সব ক্রিকেটার রয়েছে। বিশেষ করে কোচেদের টিমটা দারুণ। সানরাইজার্স হায়দরাবাদে আমার প্রথম বছর থেকে যে রকম সমর্থন পেয়েছি, কখনও ভোলা যাবে না। মুরলী স্যর আমাকে নেটে সারাক্ষণ সময় দেন। সব সময় বলতে থাকেন, রশিদ, তোমার স্কিল আছে। বৈচিত্র আছে। বলেন, স্কিলের দিক থেকে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে তুমি। শুধু একটা জিনিসই করতে হবে। নিজের মাথাটা ঠান্ডা রাখো। মুরলী স্যারের পরামর্শ দারুণ কাজে লেগেছে।
প্র : বিশ্বকাপ আসছে। আরো একটা স্বপ্নপূরণের মঞ্চ নিশ্চয়ই?
রশিদ : আফগানিস্তানের মতো দেশের কাছে দ্বিতীয় বার বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়াটা স্বপ্ন পূরণের মতোই ব্যাপার। আমরা টিম হিসেবে ভালো করার লক্ষ্য নিয়ে যাব। প্রমাণ করার চেষ্টা করব, বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে আমরা ভালো করতে পারি। আমাদের সকলের জন্য খুব ভালো একটা সুযোগও থাকছে। বিশ্বের সামনে নিজেদের মেলে ধরার। আমরা তৈরি। আমাদের দেশ তৈরি।
প্র : শুনেছি, আপনারা সাত ভাইয়ের প্রত্যেকেই নাকি লেগ স্পিন আর গুগলি করতে পারে। এটা ঠিক?
রশিদ : হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বলতে পারেন, লেগস্পিন বোলিংটা আমি পরিবার থেকেই পেয়েছি। বাড়ির পিছনে সকলে আমরা টেনিস বলে লেগ স্পিন করতাম। সেখান থেকেই আমার লেগ স্পিন বোলিং শেখা।
প্র: রোববারের দ্বৈরথের আগে নিজেকে কী বলবেন?
রশিদ : বলব যে, আইপিএলের আরো একটা বড় ম্যাচ হতে যাচ্ছে। দু’টো ভাল দল মুখোমুখি হচ্ছে। এ ধরনের ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, সঠিক জিনিসগুলো করার উপরে মনোনিবেশ করতে হবে। আমাদের বোলারদের হায়দরাবাদের উইকেট সম্পর্কে ভালো রকম ধারণা আছে। আমরা সবাই জানি, এখানে কী ধরনের বোলিং করতে হবে। শান্ত থাকো, স্থিতধী থাকো। সঠিক জায়গায় বল রাখো, নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দাও। পরিকল্পনা অনুযায়ী বোলিং করো। ইতিবাচক থাকো। তার পর দেখা যাবে মাঠে কী ঘটে!
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা