২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
আফগানিস্তান

ভারতের স্বপ্নভঙ্গ!

-

আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার অনিবার্য বলেই মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি কিন্তু যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে সম্মান নিয়ে ঘরে ফিরতে পারাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে বাধ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারকাজের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তার পর থেকে তার অনেক উপদেষ্টা বলে আসছেন যে, তিনি ২০২০ সালের পুনর্র্নির্বাচনের জন্য অভিযানে নামার আগে সব না হলেও বেশির ভাগ সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ট্রাম্পের চলতি সপ্তাহে করা অবিজ্ঞোচিত মন্তব্যে আফগানিস্তান ত্যাগ করার ব্যাপারে তার ইচ্ছাই প্রকাশ পেয়েছে : তিনি রাশিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের মতো আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের পরিস্থিতি স্থিতিশীলকরণে আরো সম্পৃক্ত হতে বলেছেন এবং পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন না করার জন্য ভারতকে বিদ্রুপ করেছেন।

অথচ ৯-১১ হামলার প্রতিশোধ নিতে শুরু হওয়া আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধটি একপর্যায়ে আফগানিস্তানে গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার মিশনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তালেবানের শক্তি বিপুলভাবে বৃদ্ধির ফলে ওই মিশনটি নতুন করে তৈরি করা হয়। এখন সম্মানজনক প্রস্থান নিশ্চিত করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে তা। যুক্তরাষ্ট্র এবারই প্রথম এ ধরনের কিছু করতে চাচ্ছে, তা নয়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১০ সালেও একই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বড় ধরনের হ্রাস করেছিলেন। ট্রাম্প এখন আমেরিকান উপস্থিতি হ্রাস করার পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন।

মার্কিন এই নীতির ফলে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছে ভারত। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে নজর রাখলে স্পষ্ট হয়ে যাবে, ২০১৭ সালের আগস্টে ট্রাম্প আফগানিস্তান-বিষয়ক যে দক্ষিণ এশিয়া কৌশল ঘোষণা করেছিলেন, তা পরিত্যক্ত হয়েছে। তিনটি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ট্রাম্প ওই কৌশলের কথা ঘোষণা করেছিলেন। এগুলো হলো- আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে; তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন প্রদানের বিষয়টি দেশটিকে অবহিত করা হয়েছিল, তালেবানের সাথে নিষ্পত্তি হবে কেবল সামরিক সাফল্যের পরই এবং ভারতের সাথে কৌশলগত অংশীদার আরো জোরদার করা।

মাত্র ১৬ মাসেই অবস্থা বদলাতে হলো যুক্তরাষ্ট্রের। অথচ ওই ঘোষণা প্রণয়ন করার পর ব্যাপকভাবে হামলা চালিয়ে তালেবানকে দুর্বল করার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি বলেই ভিন্ন পথ অবলম্বন করে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বরে বিশেষ দূত হিসেবে জালমি খালিলজাদকে নিয়োগের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আর সামরিক সাফল্যের জন্য অপেক্ষা করতে থাকতে চাইছে না। মার্কিন কংগ্রেসে দাখিল করা আফগানিস্তান পুনর্গঠনবিষয়ক স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেলের (এসআইজিএআর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আফগান জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীতে হতাহতের মাত্রা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আর জাতিসঙ্ঘ সহায়ক কর্মসূচির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের প্রথম ৯ মাসের তুলনায় ২০১৮ সালের প্রথম ৯ মাসে অনেক বেশি বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে।

খালিলজাদ কাতারে সরাসরি তালেবানের সাথে কথা বলার মাধ্যমে আমেরিকা তার আগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত অবস্থান থেকে সরে আসার বিষয়টি প্রকটভাবে তুলে ধরেছেন। আগে যুক্তরাষ্ট্র জোর দিয়ে বলে আসছিল যে, আফগান জাতীয় সরকারের সাথে আলোচনা না করলে তারা তালেবানের সাথে সরাসরি আলোচনা করবে না। কিন্তু এখন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানির প্রশাসনকে অন্ধকারে রেখেই যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তালেবানের সাথে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। আবার তালেবানকে সমর্থন করার জন্য পাকিস্তানের প্রতি কঠোর হওয়ার বদলে আলোচনার ব্যবস্থা করার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন ট্রাম্প। আফগানিস্তানের হাই পিস কাউন্সিলের সদস্যরা জানিয়েছেন, খালিলজাদকে ছয় মাসের সময়সীমা দিয়ে তাকে এর মধ্যে আলোচনায় অগ্রগতি দেখাতে বলা হয়েছে, যাতে এরপর দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহার করা যায়।

ট্রাম্পের আফগানিস্তান-বিষয়ক কৌশল প্রণয়ন করেছিলেন ওই সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস। সেই তিনিই পদত্যাগ করেছেন। এই ম্যাটিসই আফগানিস্তানে মার্কিন অংশগ্রহণ বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন। তা ছাড়া ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করা সত্ত্বেও ইরানের চাহাবার বন্দরে বিনিয়োগ ও ইরান থেকে তেল কেনার ব্যাপারে ভারতকে ছাড় দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনিই। এখন ট্রাম্প ওই শিথিলতা বজায় রাখবেন কি না তা দেখার বিষয়। যদি না দেয়া হয় তবে তা হবে ভারতের জন্য আরেকটি অস্বস্তিকর ব্যাপার।

এ দিকে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনিশ্চয়তার কারণে দুই বছর বিলম্বের পর অক্টোবরে পার্লামেন্ট নির্বাচন হলেও এখন পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। ফলে নির্বাচন আয়োজনে সরকারের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। অথচ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নির্বাচন হতে হবে আগামী ২২ এপ্রিলের মধ্যে। এ দিকে প্রেসিডেন্ট গানি লয়া জিরগা আয়োজনের প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারেননি। লয়া জিরগার মাধ্যমেই প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবদুল্লাকে নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করার কথা ছিল।

ভারতের জন্য এসব ঘটনা হতাশাজনক মনে হতে পারে। তবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ভারতের উচিত হবে আরো বিচক্ষণ নীতি অবলম্বন করা। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার অনিবার্য। ফলে চোখ বন্ধ করে থাকার বদলে অনিবার্যতার জন্য প্রস্তুত থাকাই ভালো হবে। পাকিস্তানকে খুশি করার জন্য ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা ভারতকে আফগানিস্তানে কম ভূমিকা পালন করতে বলেছিলেন।
ট্রাম্প প্রশাসন সন্দেহাতীতভাবে আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা বাড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন দেশটি নিজেই বিশ্বের প্রতিটি অংশ থেকে ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ নীতি থেকে সরে আসতে চাইছে। বেশির ভাগ স্থান থেকেই তাদের প্রত্যাহার বা হ্রাস করার ফলে আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে সিরিয়া থেকে প্রত্যাহারের ফলে ইরান ও এর মিত্রদের জন্য; ইয়েমেন থেকে সরে আসায় সৌদি আরবের জন্য; আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের ফলে রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরানের জন্য এবং চীনের কাছে পাকিস্তানকে দিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ভারতকে আরো কিছু কঠোর সত্যেরও মুখোমুখি হতে হবে। পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান বদলাতে পারে না ভারত। তা ছাড়া অতীতে ঘাঁটি ও ভূমি ব্যবহার করার সুযোগসহ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শক্তিকে পাকিস্তান যা দিয়েছে, তা দিতে পারে না ভারত। সার্কের বদলে বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরিয়াল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক্যাল কো-অপারেশন), বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল) ও আইওআরএ (ইন্ডিয়ান ওশ্যান রিম অ্যাসোসিয়েশন) হয়তো ‘পাকিস্তানকে একঘরে’ করার ভারতীয় নীতিতে স্বল্পমেয়াদি কিছু সুবিধা দিয়েছে; কিন্তু এর বিনিময়ে সে আফগানিস্তান হারিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব খুইয়েছে।

আফগানিস্তানে ভারতের জন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে অন্যদের নয়, নিজেদের নীতি অনুযায়ী কাজ করা। চলতি সপ্তাহে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুহিবের দিল্লি সফর নিয়ে হইচই না হলেও এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কই আফগানিস্তানকে তার প্রয়োজনের আলোকে সহায়তা করতে পারবে। এতে ভারতের উচ্চাভিলাষ পূরণ না হলেও দেশটির জনসাধারণের মধ্যে ভারতের জনপ্রিয়তা বাড়বে। এতেই ভারত ব্যাপকভাবে লাভবান হবে।

সবশেষে বলতে হবে, আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করার সাইক্লিক্যাল প্রকৃতিকেও স্বীকৃতি দেয়া উচিত। এই দেশটিকে বলা হয় ‘সাম্রাজ্যের কবরস্থান’। কারণ এখানে বিশ্বের সব পরাশক্তিই কোনো-না-কোনোপর্যায়ে পরাজিত হয়েছে। প্রথম অ্যাঙ্গো-আফগান যুদ্ধের (১৮৩৯-৪২) বেঁচে যাওয়া সৈন্য রেভারেন্ড জর্জ গ্লেইগের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধ কোনো বুদ্ধিমান উদ্দেশ্যে শুরু হয় না, তাড়াহুড়া আর ভয়-বিহ্বলতার অদ্ভুত মিশেলে এর সূচনা ঘটে, দুর্ভোগ আর বিপর্যয়ের পর তা শেষ হয়, যে লক্ষ্যে সরকার এই যুদ্ধ করেছিল, তা অর্জিতই হয় না। ব্রিটিশদের পশ্চাৎপসারণ নিয়ে গ্লেইগের ভাষ্যটি ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত সৈন্যদের এবং সেই সাথে নাইন-ইলেভেনের পরবর্তী আমেরিকান বাহিনীর পিছু হটার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আমেরিকা এখন ইতিহাস। আর এর মাধ্যমে নতুন ইতিহাস গড়ল আফগানিস্তান। একটার পর একটা সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটিয়ে তারা এই ইতিহাস ঘটিয়েছে। এখন ভারতকে এ নিয়ে ভাবতে হবে, তারা আফগানিস্তান নিয়ে কী ভাববে।


আরো সংবাদ



premium cement