২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অথচ জাহাজের হাল ধরার কথা ছিলো তার

ফখর জামান: ছিলেন নাবিক, হয়ে গেলেন ক্রিকেটার - ছবি : ইন্টারনেট

সমুদ্রগামী জাহাজের হাল ধরার কথা ছিলো যার, তিনিই আজ ব্যাট হাতে ধরছেন পাকিস্তান ক্রিকেটের হাল। ঝড়ো বাতাস কেটে জাহাজ নিয়ে এগিয়ে চলার কথা যার, তিনি দু হাতে ব্যাট দিয়ে কচুকাটা করেন প্রতিপক্ষের বোলারদের। জাহাজকে বন্দরে নেয়ার কথা থাকলেও এখন তিনি দলকে নিয়ে ছোটেন জয়ের বন্দরের দিকে। অথচ তার ক্রিকেটার হওয়ারই কথা ছিলো না। যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে নাবিক হিসেবে; কিন্তু নিয়তি যার ক্রিকেট মাঠে লেখা, সে কী অথৈ সমুদ্রে থাকতে পারে!

বলা হচ্ছে ফখর জামানের কথা। শুক্রবার জিম্বাবুয়ের বুলাওয়েতে অনেক রেকর্ড গড়া এক ইনিংস খেলেছেন ফখর জামান। পাকিস্তানের পক্ষে প্রথম ও ওয়ানডে ইতিহাসের পঞ্চম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান(২১০*) এখন এই তরুণ। উদ্বোধনী জুটিতে ইমাম উল হককে নিয়ে গড়েছেন নতুন বিশ্ব রেকর্ড। পাকিস্তানও পেয়েছে ওয়ানডে ইতিহাসে নিজেদের সর্বোচ্চ রান।

পাকিস্তানের এই তরুণ সেনসেশন অভিষেকের পর থেকেই প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে চলছেন। গত বছর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অভিষেক ফখরের। সেই টুর্নামেন্টে প্রতিটি ম্যাচেই ইনিংস ওপেন করতে নেমে পাকিস্তানকে এনে দিয়েছেন দারুণ সূচনা। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৮ উইকেটে জেতার ম্যাচে তার দুর্দান্ত হাফ সেঞ্চুরি সমালোচকদের প্রশংসা করেছে। মাইকেল ভন, স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের মতো তারকারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন ফখর জামানের। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত সেই সেঞ্চুরি, যাতে ভর করে পাকিস্তান প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির।

১৭ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে শুক্রবারের ডাবলসহ তিনটি সেঞ্চুরি আর ৫টি হাফ সেঞ্চুরি। গড় পচাত্তরের বেশি। পরের ম্যাচে মাত্র ২০ রান করলেই ওয়ানডেতে দ্রুততম এক হাজার রানের রেকর্ড গড়বেন।

পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মারদান জেলার কাতলাং এলাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফখর জামানের। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের নিয়ে বাবা মার যেমন চিন্তা থাকে- ঠিকভাবে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পাওয়ার, ফখর জামানের পরিবারও তেমনটা চাইতো। কিন্তু তার সব মনোযোগ ছিলো ক্রিকেটের দিকে। বাবা ভেবেছেন, এত ক্রিকেট প্রেম থাকলে ছেলের লেখাপড়া গোল্লায় যাবে, তাই নানা ফন্দি করতেন ছেলেকে মাঠ থেকে ফেরাতে; কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হতো না।

পরিবারের ইচ্ছেই সরকারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশের পর ২০০৭ সালে আবেদন করেন নৌবাহিনীর চাকুরির। নাবিক পদে চাকুরি হয়ে যায় ফখর জামানের। ট্রেনিং শেষে যোগ দেন চাকুরিতে; কিন্তু ওই যে ক্রিকেটই যার নিয়তি তাকে ভাগ্যই টেনে নেয় ক্রিকেট মাঠে। সে সময় নৌ বাহিনীতে টুকটাক ক্রিকেট খেলার প্রচলন ছিলো। ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে আয়োজিত হতে ক্রিকেট ম্যাচ। ফখর জামানের খেলা দেখে নৌবাহিনীর ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচ আজম খান তাকে পছন্দ করেন ক্রিকেট টিমের সদস্য হিসেবে। পরবর্তী চার বছর শুধু ক্রিকেটার হিসেবেই নৌ বাহিনীতে ছিলেন ফখর জামান। নিয়মিত ক্রিকেট খেলাই ছিলো তার চাকুরি।

কিন্তু তাতেও মন ভরছিলো না ফখর জামানের। মাঠে মাঠে ঘুরে ক্রিকেট খেলা যার অভ্যাস, প্রতিদিন দেরি করে বাড়ি ফিরে বাবার বকা খাওয়া যার রুটিন কাজ তার কী বাধা-ধরা জীবন ভালো লাগবে? ২০১৩ সালে নৌ বাহিনীর চাকুরি ছেড়ে দেন। আবার বাড়ি এসে খেলতে শুরু করেন ক্রিকেট। সে সময় একদিন তার দেখা পাকিস্তানের তারকা ক্রিকেটার ইউনুস খানের সাথে, যিনিও একই প্রদেশের লোক। ইউনুস খান তাকে উদ্বুদ্ধ করেন আঞ্চলিক ক্রিকেট দলের সাথে যুক্ত হওয়ার। জেলা পর্যায়ে অনুর্ধ -১৯ টুর্নামেন্টে খেলেন নজর কাড়েন ক্লাবগুলোর। এরপর পর্যায়ক্রমে খাইবার পাখতুনখাওয়া, অ্যাবোটাবাদ ফ্যালকন ও বালুচিস্তান দলের হয়ে আঞ্চলিক ক্রিকেটে খেলতে শুরু করেন।

২০১৬ সালে পাকিস্তান সুপার লিগের দ্বিতীয় আসরে লাহোর কালান্দার্সে সুযোগ পান ফখর, সেই শুরু মূলধারার ক্রিকেটে পথা চলার। সে বছরই ঘরোয়া ক্রিকেটের কায়দে আজম ট্রফিতে করেন ছয় শতাধিক রান, ফাইনালে খেলেন ১৭০ রানের ইনিংস। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দরজা খুলে যায় জাতীয় দলের।

যখন নাবিক ছিলেন

 

ক্রিকেট বিশ্বে আবির্ভাবের পরই সাড়া ফেলে দেয়া ফখর এখনো কৃতজ্ঞচিত্তে আজকের অবস্থানের জন্য স্মরণ করেন নৌবাহিনীতে থাকাকালীন তার কোচ আজম খানকে। তার হাত ধরেই নাবিক পরিচয় থেকে তিনি পেয়েছেন ক্রিকেটার পরিচয়। দাপটের সাথে বিচরণ করছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। প্রথম গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে মারদানে নিজের প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট অ্যাকাডেমির নামও রেখেছেন আজম খানের নামে।

পাকিস্তানের ব্যাটিং কোচ গ্রান্ট ফ্লাওয়র মনে করেন, নৌ বাহিনীতে থাকার কারণেই ফখর জামান কঠোর পরিশ্রম করার শক্তি ও চ্যালেঞ্জ জয় করার দৃঢ় মানসিকতা পেয়েছেন। সেখানে তাকে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কয়েক মাইল দৌড়াতে হতো। এরপর নাস্তা করেই যেতে হতো প্রতিদিনের ডিউটিতে। সমুদ্রে ঝড়ের বিরুদ্ধে জাহাজকে টিকিয়ে রাখার যে মানসিক শক্তি তিনি অর্জন করেছেন সেটিই আজ সাহায্য করছে বোলারদের সামনে ব্যাট হাতে দাড়াতে।


আরো সংবাদ



premium cement