১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বুয়েটও একটি ‘অবরুদ্ধ গ্রাম’

ফিরিয়ে দিতে হবে এর নির্মল পরিবেশ

-

এত দিন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, এটি দেশের সর্বাধিক মেধাবীদের প্রতিষ্ঠান। এখানে সব ছাত্র মেধাবী এবং সবাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। স্বভাবতই সবাই প্রত্যাশামাফিক ভদ্র বলে অনুমিত হওয়ায় এর ক্যাম্পাসে এক চমৎকার পরিবেশ সব সময় বজায় থাকাই দেশবাসীর কাম্য। এবার ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নিয়ে এমন সব উদ্বেগজনক খবর পাওয়া যাচ্ছে, যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে মনে হচ্ছে একটি অবরুদ্ধ গ্রাম; যেখানে ভালো ছাত্ররা সব সময় আতঙ্কে থাকেন মুষ্টিমেয় কিছু মাস্তানের ভয়ে। কারণ যেকোনো সময় সাধারণ ছাত্ররা নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার হয়ে যেতে পারেন। এমনকি সেখানে রয়েছে টর্চার সেল।
বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী ইউরিপোর্টার নামে একটি অনলাইন সার্ভার গড়ে তোলেন। সেখানে বুয়েটের যেকোনো শিক্ষার্থী নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে অভিযোগ জানাতে পারেন। চলতি বছরের মে মাস থেকে গত বুধবার পর্যন্ত সেখানে অভিযোগ পড়েছে ১৬০টিরও বেশি। আবরার হত্যার দু’দিনের মধ্যে অভিযোগ পড়েছে ৮৩টি। যেসব অভিযোগ শিক্ষার্থীরা জানিয়ে আসছেন, তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। নাম প্রকাশ না করার সুযোগ থাকার পরও ছাত্ররা যে ভীতির কারণে অভিযোগ দায়ের করতেন না, সেটি বোঝা গেল আবরার হত্যার পরপরই একসাথে অনেক অভিযোগ প্রকাশ করার মাধ্যমে। অর্থাৎ এখন সুযোগ পেয়ে নির্যাতিতরা নিজেদের অবমাননা ও লাঞ্ছনাকর ঘটনার ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করছেন।
অভিযোগগুলোতে জানা যাচ্ছে, বুয়েটের হলে হলে টর্চার সেলের কথা এবং গণপিটুনির জন্য ব্যবহার করা হয় হলের ছাদ। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকা, আচরণ ‘অপছন্দনীয়’ হওয়া, কাউকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে সন্দেহভাজন বানানোÑ এসব কারণে অভিযুক্ত ছাত্রকে টর্চার সেলে নিয়ে নির্দয়ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেটানো হতো। কাউকে ডেকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা হতো। চড়-থাপ্পড় মারা ‘নেতা’দের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কাউকে মারধর করে সেটি বৈধ করার জন্য ‘শিবির’ তকমা ব্যবহার করা সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হয়। আবরারের বিরুদ্ধে একই ধরনের তকমা দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
অসংখ্য অভিযোগের মধ্যে একটা গুরুতর বিষয় সামনে এসেছে, যা সাম্প্রদায়িক বলে মনে করা যায়। সেটি হচ্ছে, বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের কিছু ছাত্রনেতার বেপরোয়া আচরণ। তারা সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতনের ক্ষেত্রে সীমা ছাড়িয়েছে। ইউরিপোর্টারে এমন কয়েকজনের নাম এসেছে। কয়েক নেতার এমন অতি উৎসাহী হয়ে নির্যাতন চালানো এবং তাদের পার্টির পক্ষ থেকে আশকারা পাওয়ার বড় একটি নেতিবাচক দিক রয়েছে। এতে করে নির্যাতিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে বিপুল বঞ্চনার সৃষ্টি হয়। ফলে সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আবরার হত্যার ক্ষেত্রেও এমন অতি উৎসাহী হিসেবে অভিযোগ এসেছে অমিত সাহার নামে। অথচ আবরার হত্যা মামলায় তাকে আসামিদের তালিকায় রাখা হয়নি। তার রুমেই নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে নির্দোষ ছাত্র আবরারকে। হত্যার সুষ্ঠু বিচার নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে। প্রয়োজন প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। অপরাধীদের কোনো দলীয় বা ধর্মীয় পরিচয় যেন বিবেচ্য না হয়।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া সন্ত্রাস প্রকাশ্য একটি ব্যাপার। তাদের মাস্তানিতে সবাই তটস্থ। শিক্ষার পরিবেশ কলুষিত হয়ে করুণ অবস্থায় পতিত হয়েছে। এ যাবৎ বুয়েটকে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু মনে হলেও দেখা যাচ্ছে বুয়েটের অবস্থাও একই। যা হোক, ছাত্ররা তাদের ওপর পরিচালিত নিপীড়নের অভিযোগ জানাচ্ছেন ইউরিপোর্টারে। কর্তৃপক্ষের উচিত এসব অভিযোগ যাচাই করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এতে করে বুয়েটের কলঙ্ক অপনোদন হওয়া সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ বুঝি না’, অপরাধীদের বিচার করতে হবে। অপর দিকে, দেখা গেল ‘ইউরিপোর্টার’ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
আমরা মনে করি, বুয়েটে নির্যাতনকারী সব দুর্বৃত্তকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বুয়েটকে ফিরিয়ে দিতে হবে আগের সেই নির্মল এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ।


আরো সংবাদ



premium cement