২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যশোরে বিলুপ্তির পথে খেজুরগাছ   খেজুরের রস আর গুড় এখন ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য

-

বলা যায় স্মরণাতীতকাল থেকে খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত যশোর জেলা। এ জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার একেবারে দক্ষিণ সীমানার একটি গ্রাম। নাম খলসী। এ গ্রামের মরহুম গাজী রহমান তার বাবার কাছ থেকে চাষাবাদের সাথে খেজুরগাছ কাটার দায়িত্ব পান আনুমানিক ১৯৫৮ সালের দিকে। তার পর ১৯৮৫ সালের দিকে বার্ধক্যে পৌঁছে তিনি গাছ কাটার দায়িত্ব ছেড়ে দেন তার দুই ছেলে রওশন আলী আর আইয়ুব আলীর হাতে। তারা কাজটি করেছেন ২০১৮ সাল পর্যন্ত। তার পর বয়সের ভারে এখন আর তারা গাছে উঠতে পারেন না। তাদের বাবার সময় থেকে খেজুরগাছ ছিল এক পোন অর্থাৎ ৮০টিরও বেশি। দুই ভাইয়ের বয়স বৃদ্ধির সাথে গাছের সংখ্যা কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে গোটা বিশে। এ বছর গাছ তোলাই হয়নি। তাদের দু’জনের চার ছেলেই বিদেশে। ফলে খেজুরগাছ আর কাটা হচ্ছে না। তা ছাড়া গাছ কাটার অতিশয় শ্রমসাধ্য কাজ করার জনমজুর পাওয়া যায় না।
খেজুরগাছ কাটা এবং রস থেকে গুড় তৈরির আরো সমস্যা আছে। রওশন বলেন, গাছ তোলার (রসের জন্যে কাটার উপযোগী করা) জন্য একসময় গ্রামে পারদর্শী মজুর মিলত। গাছের মাথায় দড়ার একপাশে ঝুলে অনেক সময় ধরে খেজুরের পাতা-বাকল কেটে পরিষ্কার করার কাজ করা খুব কঠিন। আবার একটু অসাবধান হলে পা পিছলে পড়ে জীবন হারানোর, কমপক্ষে কোমর ভেঙে পঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা। তাই এ কাজ তারাই করতেন যাদের শরীরে থাকত তাকত আর মনে দুরন্ত সাহস। অবশ্য এ কাজে মজুরি মিলত একটু বেশি। কিন্তু এখন আর কেউ ওই কষ্টসাধ্য ও বিপদসঙ্কুল এ কাজ করতে চান না। তার পরের বড় সমস্যা জ্বালানি। আগে গাছ তোলার সময় খেজুরগাছের কেটে ফেলা পাতা-বাকল শুকিয়ে বেঁধে (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ঝোড়) স্তূপ করে রাখা হতো। তা দিয়ে মৌসুমের অর্ধেক সময় রস জ্বালানো চলত। আর বাকি সময়ের জ্বালানি চাহিদা মিটত ধানের নাড়ায়। বিলে বৈশাখ মাসে ধান বোনা হতো। সেই ধান গাছ সারা বর্ষা পানি বাড়ার সাথে সাথে সাত-আট হাত পর্যন্ত লম্বা হতো। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বিলের পানি কমলে ওপর থেকে ধান কেটে নেয়া হতো। আর নাড়া টেনে ডাঙ্গায় তুলে শুকিয়ে জ্বালানি বানিয়ে নেয়া হতো। এখন বিল মজে গেছে। সেখানে চাষ হয় রোপা আমন আর বোরো ধানের। নাড়া আর মেলে না। এ ছাড়া রস জ্বালানোর জন্য সুবিধাজনক মাটির বড় হাঁড়ি, রস-গুড় রাখার ভাড় (ঠিলা) এসব এখন সহজে মেলে না। এলাকার কুমারদের অনেকেই দেশত্যাগী হয়েছেন, না হয় বিকল্প পেশা গ্রহণ করেছেন।
যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর কাছারিবাড়ি গ্রামের আরশাদ আলী গাজীর সাথে কথা বলে একই চিত্র পাওয়া যায়। ৫০ বছর বয়সী আরশাদ জানালেন, অতিথি সেবার জন্য এক ভাড় রসের কথা আগের দিন বলে রেখেছিলাম। পরদিন তা দিয়ে রসপিঠে তৈরি হয়েছে। অথচ তার বাপ নিজেদের এক পোন গাছ কাটতেন। বাবা বৃদ্ধ হলে যখন কাটতে পারতেন না, তখন মজুর দিয়ে কাটানো হতো। তিনি ও তার ছেলে গ্রামের বাজারে দোকানদারি করেন। গাছে উঠতে পারেন না। এখন মজুরও মেলে না। ফলে সব খেজুরগাছ মেরে ফেলা হয়েছে। এ গ্রামের মাঠে অনেক খেজুরগাছ দেখা গেল মাঘ মাসেও তোলা হয়নি। আবার কিছু গাছ তোলা হয়েছে, কিন্তু কাটা হচ্ছে না।
শীতের মাসগুলোতে গ্রামের গৃহস্থ বাড়ি সারা দিনই ব্যস্ত থাকত রস-গুড়সংক্রান্ত কাজে। খুব ভোরে পুরুষরা গাছ থেকে রস নামিয়ে বাড়ি আনার পর মেয়েরা ব্যস্ত হতেন রস জ্বালিয়ে গুড় করতে। এ করতে করতে দুপুর। এর মধ্যেই ভাড়গুলো ধুয়ে উঠানে উপুড় করে সারি দিয়ে রাখা হতো। গাছ কাটা শুরুর আগে ভাড়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে আগুনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে নেয়া হতো। এবারের ভরা মাঘে দুই উপজেলা ঘুরে এসব দৃশ্য চোখে পড়েনি বললেই চলে। সন্ধ্যার আগে মনিরামপুরের শেষ গ্রাম কপালিয়া পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে নজর দিয়ে গাছ কাটায় ব্যস্ত গাছিদের দেখা মেলেনি।
অতীতে খেজুরগাছের ওপর নির্ভশীলতার অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক। তখন এ অঞ্চলের বেশির ভাগ কৃষক পরিবারের পোশাক-আশাক এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্যে অর্থাগমের দু’টি কৃষিপণ্য ছিল। একটি পাট ও অন্যটি গুড়। রওশন আলীর ভাষায়, আমরা ছোট বেলায় দেখেছি, আব্বা রস ওঠার পরে দু-তিনবার চার ভাড় গুড় কাঁধে নিয়ে হেঁটে চার মাইল দূরের বাঁকড়ার হাটে যেতেন। চার ভাড় গুড় বেঁচে খুব বেশি হলে পেতেন ১০ টাকা, শেষের দিকে দাম একটু বেশি পেতেন। তাই দিয়ে পরিবারের জন্য কাপড় নিয়ে আসতেন। এখন ওসব খরচ অন্য উপায়ে ভালোভাবে মিটছে। বাধ্য হয়ে খেজুর বাগানের গাছ সব মেরে দিয়ে সেখানে আম বাগান করেছি। তা ছাড়া খেজুরগাছের কাঠ জ্বালানি ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না। আগে তাও তো খড় আর টালির ঘর ছিল। খেজুরগাছ পেকে গেলে ফেঁড়ে কয়েক ফালি করে ঘরের চালে লাগানো হতো। এখন ঘরবাড়ি সব পাকা হয়ে গেছে।
খেজুরগাছ কমে যাওয়ার জন্য ইটভাটা দায়ী, এটা ভুল ধারণা। বিভিন্ন গ্রামের গাছিদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, দিন বদলের হাওয়ায় তাদের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। গাছকাটার মতো একটি শ্রমসাধ্য পেশায় নতুন করে কেউ যুক্ত হচ্ছে না। বাপ-দাদার আমলে তাদের যেসব খেজুরগাছ ছিল, তা বিক্রি করে দিচ্ছে। খেজুরগাছ দিয়ে জ্বালানি ছাড়া অন্য কিছু হয় না বলে ভাটায় বিক্রি হয়। অনেক ক্ষেত্রে তা বাড়ির জ্বালানি চাহিদাও মেটায়।
খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল জেলায়ও (এগুলো একসময় যশোর জেলারই অংশ ছিল) খেজুরগাছের চাষ আছে। একসময় যশোরে গুড়ের চিনি তৈরি করতেন চাষিরা। ১৮৬১ সালে এক ইউরোপীয় বণিকের যশোরের চৌগাছায় চিনিকল স্থাপনের কথা জানা যায়। আর গুড়ের ব্যবহার ছিল নানা খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে। বাড়িতে তৈরি হতো রসের ক্ষীর ও পিঠা, গুড় দিয়ে হতো তেলের পিঠাসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার। গৃহস্থ গুড় বিক্রি করলেও সারা বছর খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গুড় ভাড় বা কলসে ভরে মুখে নারকোলের মালা ও কাঁদার প্রলেপ দিয়ে (পোকামাকড়ের সংক্রমণ রোধ করতে) মাচায় তুলে রাখতেন। এখন এসব অতীতের গল্প হতে চলেছে।
যশোরের একজন প্রবীণ সাংবাদিক বছর চারেক আগে এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘খেজুরের রস-গুড় এখন যশোরের ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য। তবু কুয়াশার চাদর মোড়ানো মাঘের সকালে যশোর জেলার মাঠে মাঠে এখনো খেজুরগাছ থেকে রস নামাতে ও বিকেলে গাছ কাটতে গাছিদের ব্যস্ত দেখা যায়। আর বাড়িতে বাড়িতে গাছি-বধূরা ক্লান্তিহীন সময় পার করছেন সেই রস জ্বালিয়ে নিপুণ হাতে গুড়-পাটালি তৈরির কাজে। এখনো এ জেলার গাঁয়ের পথ দিয়ে হাঁটলে গুড়ের ম ম গন্ধে মন-প্রাণ ভরে যায়।’ কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে গ্রামগুলোর বাতাসে রস গুড়ের গন্ধ আর তেমন পাওয়া যায় না। সে দিন হয়তো খুব কাছে, যখন খেজুরগাছও আর দেখা যাবে না।


আরো সংবাদ



premium cement