১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঐতিহাসিক ছোট ও বড়কাটরা পুস্তকে থাকলেও বাস্তবে নেই

রাজধানীর পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক ছোট ও বড়কাটারা হ নয়া দিগন্ত -

পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে মোগল আমলে যে স্থাপনা দু’টি দৃষ্টিনন্দন ছিল সেই বড়কাটরা ও ছোটকাটরা এখন বিলীন প্রায়। মুঘল আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনা দু’টি বইয়ের পাতায় থাকলেও বাস্তবে এর ধ্বংসাবশেষের সামান্য চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মধ্য এশিয়ার ক্যারাভান সরাইয়ের ঐতিহ্য অনুসরণে নির্মিত হয়েছিল বড়কাটরা। মুঘল রাজকীয় স্থাপত্যরীতির সব বৈশিষ্ট্য এতে ছিল। বড়কাটরায় ফারসি ছন্দোবদ্ধ পঙ্তিযুক্ত দু’টি শিলালিপি আছে। সে অনুযায়ী ১৬৪৩-৪৪ সালে এটি নির্মিত। বড়কাটরা নির্মাণ করেছিলেন সুবেদার সুলতান মুহম্মদ সুজার প্রধান স্থপতি আবুল কাশিম। আর ছোটকাটরা শায়েস্তা খানের আমলে তৈরি একটি স্থাপনা বা ইমারত। স্থাপনা দু’টি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী দুটি দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বড়কাটরা ভবনে হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার চকবাজার থানা থেকে দক্ষিণ বুড়িগঙ্গার তীরে ১৬, বড়কাটরায় এটি অবস্থিত। আর ছোটকাটরা ঢাকার বড়কাটরা হতে প্রায় ১৮৩ মিটার পূর্ব দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত।
বড়কাটরার চারটি প্রবেশ পথের পরেই ছিল অষ্টকোণাকৃতির একটি হল কামরা এবং এর উপরের ছাদ ছিল গম্বুজ আকৃতির এবং তাতে পলেস্তরার ওপর নানা রকম লতাপাতা সুন্দর অলঙ্করণ ছিল। এ হল কামরার মাঝামাঝি অংশের সোজা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছিল পর পর দু’টি করে কামরা। কাটরার ভেতর দিকে দোতলা ও তিন তলায় ওঠার সিঁড়ি আছে। উপরে দোতলায় এবং তিন তলায় নির্মিত ছিল বসবাসের কক্ষ। শুধু প্রবেশপথের ওপরের অংশই ছিল তিন তলাবিশিষ্ট। তিন তলার কক্ষগুলো চতুষ্কোণাকার এবং অশ্বক্ষুরাকৃতি ফ্ল্যাট আর্চসংবলিত ছিল। কাটরার বাকি অংশ ছিল দ্বিতল।
প্রবেশপথ এলাকায় দু’পাশে নিচতলায় প্রত্যেক ভাগে ৫টি করে ভল্টেড কক্ষ রয়েছে যেগুলোতে বর্তমানে সাদা পলেস্তরা করা হয়েছে। প্রত্যেক দিকের শেষ দু’টি কক্ষ থেকে উত্তর ভাগে কিছু অংশ কেটে নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একটি করে আলাদা কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর সামনে আছে টানা বারান্দা।
দক্ষিণ ব্লকের দুই কোণে দু’টি বিরাট টাওয়ার রয়েছে। অষ্টকোণাকৃতির টাওয়ারগুলো ফাঁকা প্যানেল অলঙ্করণ সংবলিত এবং ব্যাস ৩.০৪ বর্গমিটার। কোণার কক্ষগুলো থেকে এ টাওয়ার দু’টিতে যাওয়া যায়। এক সময় স্থাপত্য সৌন্দর্যের কারণে বড়কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি ভগ্নাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় বড়কাটরার তোরণে ফারসি ভাষায় শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজী লিখিত একটি পাথরের ফলক লাগানো ছিল। যেখানে এই মুসাফির খানার নির্মাতা ও এর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়নির্বাহের উপায় সম্পর্কে জানা যায়।
অতীতের অবকাঠামোর সাথে যুক্ত করে বর্তমানে আরো নতুন ভবন সংযোজন করে মাদরসার শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছে। মাদরাসার তত্ত্বাবধানে শুধু বড়কাটরার মূল গেটসহ কিছু ভবন রয়েছে। অন্যগুলো বেদখল হয়ে গেছে। স্থাপনা ভবনটি সময়ের পরিবর্তনে সংস্কারের অভাবে অতীত সৌন্দর্য হারাচ্ছে। স্থাপনা প্রাঙ্গণে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি লাইব্রেরি রয়েছে। অন্য দিকে ছোটকাটরা শায়েস্তা খানের আমলে তৈরি একটি স্থাপনা বা ইমারত। আনুমানিক ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালের দিকে এ ইমারতটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং তা ১৬৭১ সালে শেষ হয়েছিল। এটির অবস্থান ছিল বড়কাটরার পূর্ব দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ইমারতটি দেখতে অনেকটা বড়কাটরার মতো হলেও এটি আকৃতিতে বড়কাটরার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই এটির নাম ছোটকাটরা। বর্তমানে ছোটকাটরা বলতে একটি ভাঙা ইমারত। যা বিশাল তোরণের মতো সরু গোলির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দখলদাররা চার দিকে অসংখ্য দোকান নির্মাণ করে এমনভাবে দখলে নিয়েছে দেখে বোঝা যাবে না যে, এটা একটি মুঘল আমলের স্থাপনা।
শায়েস্তা খানের আমলে ছোটকাটরা নির্মিত হয়েছিল প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য। কোম্পানি আমলে ১৮১৬ সালে মিশনারি লিওনারদ ছোটকাটরায় ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে অথবা বিশ শতকের প্রথম দিকে ছোটকাটরা ছিল নবাব পরিবারের দখলে এবং তাতে তখন কয়লা ও চুনার কারখানার কাজ চলত। বর্তমানে ছোটকাটরাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এখনো দাঁড়িয়ে আছে এর ধ্বংসাবশেষ। ঐতিহাসিক যেকোনো স্থাপনার আশপাশের ২৫০ মিটার এলাকাকে ‘বাফার জোন’ বলা হয়। যেখানে কোনো বহুতল ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ। অথচ সরেজমিন দেখা গেছে, ছোটকাটরার কিছু অংশ দখল করে আছেন স্থানীয় কিছু সাবান ও প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মালিকরা। বিভিন্ন বহুতল ভবনের আধিক্যে আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিদর্শন। যেগুলো খুঁজে বের করতে ঐতিহ্যপ্রেমীদের বেশ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভবন নির্মাণ ও দখল চলছে কয়েক শ’ বছরের পুরনো মুঘল স্থাপত্য ছোটকাটরার ভেতরে ও বাইরে। একই পরিস্থিতি বড়কাটরার ভেতরেও। বহুতল কোল্ড স্টোরেজ এবং আবাসিক ভবনের কারণে সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে ঐতিহাসিক নিদর্শন ছোট ও বড়কাটারা।
২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাজউকের এক গেজেটে বলা হয়, ‘নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ব্যতীত তালিকাভুক্ত হেরিটেজ ভবন, স্থাপনা অপসারণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পুনঃনির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।’ প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহ্য আইন-২০০৪ এর খসড়া আইনের ১৮ ধারায় বলা আছে, ‘কোনো স্থাবর প্রতœসম্পদ সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে (ভূমি মালিকানা যার থাকুক না কেন) তা ধ্বংস, ভাঙা, বিনষ্ট, পরিবর্তন, ক্ষতিসাধন করা হলে সর্বোচ্চ ১০ (দশ) বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ জানা গেছে, মুঘল সম্রাট শাজাহানের ছেলে শাহ সুজার প্রাসাদ বানানোর লক্ষ্যে ১৬৪১ সালে নির্মিত হয় বড়কাটরা। আর মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খান আনুমানিক ১৬৬৩-৬৪ সালে নির্মাণ করেন ছোটকাটরা। নির্মাণশৈলী পছন্দমতো না হওয়ায় পরবর্তীতে এই স্থাপনা দু’টি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। পরে বড়কাটরায় মাদরাসা স্থাপিত হয়।
গতকাল ঢাকার ঐতিহাসিক বড়কাটরা পরিদর্শনকালে কথা হয় বড়কাটরা ভবনে স্থাপিত হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা সাইফুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, ২০১৩ সাল থেকে তিনি ওই পদে কর্মরত আছেন। এর আগে এই মদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন তারই শ্বশুর মুফতি ফজলুল হক আমিনী। তিনি জানালেন বড়কাটরা মাদরাসাটি অনেক পুরানো। ১৯৩১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশিষ্ট আলেম শামসুল হক ফরিদপুরী, মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর ও মাওলানা আবদুল ওহাব পীরজি হুজুর এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে কেরানীগঞ্জের খান বাহাদুর পীর হাফেজ মোহম্মদ হোসেন তার নামে রেকর্ডভুক্ত জমি মাদরাসার নমে ওয়াকফ করে দেন। বর্তমানে মাদরাসাটিতে ৮৯০ জন আবাসিক ৫৫০ জন অনাবাসিক ছাত্র বিনা বেতনে পড়াশোনা করছেন। ৪৯ জন শিক্ষক ও ১৩ জন স্টাফ মাদরাসাটি পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, ভবনটি সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধীনে থাকায় দখলদাররা এটি দখল করতে পারেনি।
বইয়ে থাকলেও বাস্তবে নেই বড় ও ছোটকাটরা
পাঠ্যপুস্তকে বড়কাটরা ও ছোটকাটরার নাম থাকলেও মুঘল আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনা দু’টি বাস্তবে এর ধ্বংসাবশেষের সামান্য চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বিশেষ করে ঢাকায় যারা থাকেন বা বেড়াতে আসেন বইয়ের পাতায় এত বেশি পড়ার ফলেই হয়তো শখ জাগতে পারে স্থাপনা দু’টিতে ঘুরে আসার। যদি সেই শখ চেপে বসে এবং আপনি যদি সত্যি সত্যি পুরান ঢাকার যানজট আর ঘিঞ্জি রাস্তা পেরিয়ে সেখানে যান, তবে হতাশ হয়ে বুড়িগঙ্গার সোয়ারিঘাটসংলগ্ন স্থাপনা দু’টির ধ্বংসপ্রায় ফটক দেখেই শখ মেটাতে হবে। একসময় স্থাপত্য দু’টির সৌন্দর্যের কারণে বড়কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি ছাড়া আর কিছুই নেই। ধ্বংসাবশেষ হিসেবে যে ফটকটি রয়েছে সেটিও দখল হয়ে গেছে পুরোপুরি। সেই ফটকের নিচে গড়ে উঠেছে খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন দোকান। ওই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ীদের কাছে বড়কাটরা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা এর ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানালেন।


আরো সংবাদ



premium cement