১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

থানার পাশেই চার ক্যাসিনো ঘুমের ঘোরে পুলিশ

ক্লাবপাড়ায় চলছে আতঙ্ক
-

থানার আশপাশেই চারচারটি ক্যাসিনো। যেখানে চব্বিশ ঘণ্টাই ছিল লোকজনের আনাগোনা। ক্যাসিনোতে চলত জুয়াড়িদের নানা খেলা। সাথে চলত মাদক গ্রহণ; কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ক্লাবগুলোতে এই অবৈধ ক্যাসিনো চললেও পুলিশের চোখ পড়েনি কখনো। যেন পুলিশ এ ব্যাপারে ঘুমের ঘোরে ছিল।
রাজধানীর ফকিরাপুলের কালভার্ট রোডে মতিঝিল থানার পাশে এই চারটি ক্যাসিনোর অবস্থান। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে আশপাশের ব্যবসায়ীদের সবাই জানত এই ক্যাসিনোগুলোতে প্রতিদিন বসে জুয়ার আসর। অভিযোগ রয়েছে, চারচারটি ক্যাসিনো নাকের ডগায় চললেও এবং দীর্ঘ দিন ধরে এলাকাজুড়ে চাঁদাবাজি চললেও কোনো ধরনের নজর দেয়নি মতিঝিল থানা পুলিশ। বরং জুয়ার টাকার বখরা পকেটে নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকত পুলিশ কর্মকর্তারা।
মতিঝিল থানার আশপাশে ক্লাবগুলো হচ্ছে, ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সঙ্ঘ ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব। এগুলো ক্রীড়াঙ্গনের মূলধারার ক্লাব হিসেবে পরিচিত থাকলেও গত পাঁচ-সাত বছর ধরে এসব ক্লাবের মূল কর্মকাণ্ডই ছিল ক্যাসিনো পরিচালনা। পাশাপাশি বিক্রি হতো বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। এসব ক্লাবে ক্যাসিনোর আড়ালে নারীদের আনাগোনা এবং অশ্লীলতাও চলত। স্থানীয়রা জানান, চারটি ক্লাবই ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকত। অনেক লোকজন আসা-যাওয়া করত।
গত বুধবার ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালায় র্যাব। আর এর মধ্য দিয়েই এসব ক্লাবের ভেতরে দেশে নিষিদ্ধ ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার খবর দেশবাসী জানতে পারে। এ সময় অবৈধভাবে ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। তিনি ইয়ংমেন্স ক্লাবের সভাপতি।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের চার দিনের মাথায় ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। এর মধ্যে ফকিরাপুলের দু’টি ক্যাসিনো সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। ক্লাবের আড়ালে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব দু’টিকে র্যাব সিলগালা করলেও বাকি দু’টি ক্লাবের কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ক্লাব বন্ধ রেখেছে। একই রাতে ঢাকার বনানী, মতিঝিল, ফকিরাপুল ও গুলিস্তানের ক্যাসিনোতে অভিযান পরিচালনা করে র্যাব-৩ ও ১। অভিযানে ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র ও বনানী আহম্মেদ টাওয়ারের গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ নামক ক্যাসিনোগুলো সিলগালা করে দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় যাতায়াতকারী একাধিক ব্যক্তি জানান, এসব ক্লাবে শুধু জুয়াড়িদের আনাগোনাই ছিল না। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের আনাগোনা ছিল। তাদের অনেকে ক্যাসিনোতে জুয়া খেলায় অংশ নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, ঝামেলা এড়ানোর জন্য এসব ক্লাবের ক্যাসিনো থেকে মাসোয়ারা পেতেন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্য। একই সাথে মতিঝিল থানায় দেয়া হতো বড় অঙ্কের মাসোয়ারা।
এ দিকে ক্লাব বা ক্যাসিনোতে র্যাবের অভিযানের পর থেকে রাজধানীর ক্লাবপাড়াসহ অভিজাত এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ক্লাবগুলোতে চলছে আতঙ্ক। এসব ক্লাবের বেশির ভাগই তালা লাগিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন পরিচালকেরা।
সূত্র জানায়, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ক্লাবের ক্যাসিনোতে বছরের পর বছর ধরে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, ৯ তাস, রেমি, ফ্ল্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা বা কথিত ইনডোর গেমসের নামে জুয়া খেলা চলছে। এসব ক্লাবে ক্যাসিনোর নামে শুধু জুয়া খেলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, পাশাপাশি অবাধে মাদক বেচাকেনা ও নারীদের নিয়ে অশ্লীলতা চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ক্লাব প্যাভিলিয়ন ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, ডিটিএস ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বিজি প্রেস স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সঙ্ঘ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি ক্রীড়াচক্র বিমানবন্দর কমান্ড। এ ছাড়া রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, সেগুনবাগিচা ও মিরপুর এলাকায় রয়েছে ক্লাবের নামে বিভিন্ন ক্যাসিনো।
রাজধানীর বাইরের ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বর্ণালী সংসদ, বগুড়ার রহমান নগর ক্রিকেট ক্লাব, চাঁদপুরের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, ফ্রিডম ফাইটার (৫ নম্বর গুপ্তি ইউনিয়ন পরিষদ), নোয়াখালীর শহীদ শাহ আলম স্মৃতি সংসদ হলরুম, সোনাইমুড়ী, বরিশালের সেতুবন্ধন ক্লাব ও লাইব্রেরি ও চট্টগ্রামের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের নাম। তবে র্যাবের অভিযানের পর এসব ক্লাবের লোকজন এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।


আরো সংবাদ



premium cement