২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুরনো সিন্ডিকেট ফের মালয়েশিয়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর কাছে বায়রার চিঠি

-

মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতারসহ আর যেন কোনো দেশেই বিগত দিনের মতো শ্রমিক পাঠাতে সিন্ডিকেট তৈরি হতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রার) পক্ষ থেকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বায়রার পক্ষ থেকে দেয়া চিঠিটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে মন্ত্রণালয় থেকে মালয়েশিয়া সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এ দিকে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার একাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, পুরনো সিন্ডিকেটের চিহ্নিহ্নহ্নত সদস্যরা মালয়েশিয়ায় থাকা বিতর্কিত ব্যবসায়ী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দাতো শ্রী আমিন নূরের মাধ্যমে আবার কর্মীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার মেডিক্যাল সেন্টার অনুমোদন এবং মালয়েশিয়ার পুরো শ্রমবাজার ফের নিয়ন্ত্রণে নিতে যাচ্ছে। প্রতি মেডিক্যাল সেন্টারের জন্য ‘এক মিলিয়ন মালয়েশিয়ান রিংগিট’ চেয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে ম্যাসেজ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার ৬০টি মেডিক্যাল সেন্টার অনুমোদন দেয়া হবে বলেও পুরনো সিন্ডিকেটের পক্ষে কেউ কেউ ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে ‘অফার’ দিচ্ছেন বলে ব্যাপক গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে গতকাল মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী দাতো আমিন নূরের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। একইভাবে ঢাকায় আমিন নূরের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে পরিচিত এবং সাবেক বায়রার সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন স্বপনের সাথে এমন অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে এর আগে তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেছিলেন, তিনি আর কোনো দিন কোনো সিন্ডিকেটের সাথে থাকবেন না।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের কাছে ‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত রাখা’ প্রসঙ্গে চিঠি দেন বায়রা সভাপতি বেনজীর আহমদ এমপি। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, আপনি অবগত আছেন, গতবার প্রায় ১২০০-এর বেশি বায়রার বৈধ সদস্যদের মধ্যে মাত্র ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে অনুমতি প্রদান করা হযেছিল। যার ফলে নানান অনিয়ম, উচ্চ অভিবাসন ব্যয়, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সিন্ডিকেটেশনসহ নানা অনিয়ম হয়েছিল। এ কারণে আমাদের ৯৫ শতাংশ সদস্যই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং যারা ব্যবসা সংগ্রহ করেছিলেন তারাও নির্ধারিত ১০ জনের মাধ্যমে তাদের চাহিদা প্রসেসিং করতে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে প্রসেসিং করতে বাধ্য হয়েছেন। আপনি এ বিষয়ে আরো অবগত আছেন, এই ১০টি এজেন্সির সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। এমতাবস্থায় উপরি উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে আপনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মালয়েশিয়াসহ অন্য সব শ্রমবাজারে বায়রার সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির কাজ করার সুযোগের ব্যবস্থা করবেন।
চিঠিতে বায়রা সভাপতি বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি যে, গতবারের মতো মালয়েশিয়া শ্রমবাজারের স্বাস্থ্যপরীক্ষাসহ কর্মী প্রেরণের যে সিন্ডিকেট করা হয়েছিল তারা আগের মতো বাজারটি সব রিক্রুটিং এজেন্সির অধিকার বঞ্চিত করে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বায়রার বর্তমান কমিটির পক্ষ থেকে দৃঢ়ভাবে আপনাকে অবহিত করতে চাই, আমরা যেকোনো দেশের শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে আপনার দৃঢ় নেতৃত্বে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকারাবদ্ধ। আপনার কাছে সবিনয় অনুরোধÑ যাতে কোনোভাবেই ভবিষ্যতে সিন্ডিকেট সক্রিয় হতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা মন্ত্রীকে দেয়া ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এর আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়া ইন্টারন্যাশনাল একটা শ্রমবাজার। এটা তো আমাদের ওপর ডিপেন্ড করছে না। আমরাতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বন্ধ হওয়া মার্কেট খোলা একটু সময়ের ব্যাপার। ভিজিট চলছে কন্টিনিউয়াস। মন্ত্রী মহোদয় যাচ্ছেন। তারাও আসতেছেন। আমরা আশাবাদী, আলোচনা চলছে, নেগোসিয়েশন চলছে। আমরা চেষ্টা করছি, মার্কেট নিয়ে যে ঝামেলাগুলো ছিল সেগুলো যাতে আর না হয়। আমরা সেভাবেই কাজ করছি।
এবার মালয়েশিয়া সরকার কি ‘বায়ো-রিক্রুটিংমেন্ট’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার কোনো চিন্তা করছে কি নাÑ প্রশ্নের উত্তরে প্রবাসী কল্যাণ সচিব বলেন, এখন কোন সিস্টেম হবে সেটা নিয়েই আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আগের (এসপিপিএ) সিস্টেম তো বন্ধ করে দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। এখন তারা কিভাবে শ্রমিক নিতে চাচ্ছে সেটি নিয়ে আগামী মাসে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে আলোচনা হবে। নেপালের শ্রমবাজার মালয়েশিয়া সরকার গত সপ্তাহে উন্মুক্ত করেছে। ওদের আগে তো আমাদের শ্রমবাজার খুলে যাওয়ার কথাÑ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নেপালের বাজার খুলে যাওয়ায় এখনই আমাদের জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি হলো। আলোচনায় আমরা বলতে পারব, নেপালের সাথে চুক্তি করেছেন, আমাদের সাথে চুক্তি করতে অসুবিধা কোথায়? এটা আমাদের পক্ষ থেকে তাদের বলা হবে। এটাই আমাদের এখন নেগোশিয়েশন করার পয়েন্ট। আমাদের লোকগুলোর কারণেই কি (পুরনো সিন্ডিকেট) মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ সরকার এখনো বাংলাদেশের শ্রমবাজার খুলতে অপারগ কি নাÑ প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, এটাই তো হলো আমাদের মূল সমস্যা। এ ব্যাপারে তিনি মিডিয়াকে আরো সোচ্চার হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, সুস্থ মানসিকতা থাকলে এটা হতো না। যাক আমরা সবার জন্য ব্যবসা উন্মুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ দিকে গতকাল মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে গত সপ্তাহে একটি চিঠি মালয়েশিয়ার শ্রম সংশ্লিষ্ট দফতরে দেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে আগেই কোনো ধরনের সিন্ডিকেট হতে দেয়া হবে না বলে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপরও পুরনো সিন্ডিকেটের হোতা দাতো আমিন নূর এবং বাংলাদেশে তার একজন বিশ্বস্ত সহযোগী এখনো মেডিক্যাল সেন্টারসহ শ্রমবাজার নতুন ফর্মেটে নিয়ন্ত্রণে নিতে যা যা করা দরকার তার সব তৎপরতাই তারা অব্যাহত রাখছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ দিকে জনশক্তি রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার কেউ সিন্ডিকেট করে ব্যবসা শুরুর চেষ্টা করলে সাথে সাথে তাদের প্রতিষ্ঠান তছনছ করে দেয়া হবে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইতোমধ্যে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ব্যবসায়ীদের টোপ দেয়া শুরু করেছেন। প্রতিটি মেডিক্যাল সেন্টার পেতে হলে নাকি তাদের এক মিলিয়ন রিংগিট দিতে হবে। ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে চক্রের সাথে কারা জড়িত তাদের মুখোশ উন্মোচন করে আইনের আওতায় আনার জন্য হতাশায় থাকা জনশক্তি ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছিল। এরপর দেশটিতে কলিং ভিসায় পৌনে ৩ লাখ শ্রমিক পাড়ি জমায়। ২০১৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর থেকে জি টু জি প্লাস পদ্ধতির এসপিপিএ সিস্টেম বাতিল করে দেশটির সরকার। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত দেশটিতে আর বৈধভাবে কোনো শ্রমিক যেতে পারেনি।
মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচনে নাজিব রাজাক সরকারের পতন হলে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি দায়িত্ব নিয়ে কোনো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বিদেশী কর্মী নিয়োগ হতে দেয়া হবে না সাফ জানিয়ে দেন। এরপরই মালয়েশিয়ার বাংলাদেশের হাইকমিশনার অভিজ্ঞ ও দক্ষ কূটনীতিক মুহ. শহীদুল ইসলাম দেশটির সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করে সিন্ডিকেটমুক্ত শ্রমবাজার উন্মুক্তের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে হাইকমিশন ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement