২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বৃদ্ধাকে নির্যাতনকারী উজিরপুরের ওসি মিডিয়া ম্যানেজ মিশনে

-

বরিশালের উজিরপুর মডেল থানার অফিস কক্ষে প্রকাশ্যে এক বিধবা বৃদ্ধাকে নির্যাতনকারী উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিশির কুমার পাল নিজের অপকর্ম ঢাকতে ও স্থানীয় সাংবাদিকদের মুখ থামাতে টাকার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে। শনিবার সন্ধ্যায় কয়েকজন সাংবাদিকদের সাথে গোপন বৈঠক করে এবং কথিত সাংবাদিক নেতাদের তার পক্ষে নিউজ করানোর জন্য ঠিকাদারি দিয়ে মোটা অংক প্রদান করেন। এ ছাড়া অভিযোগকারী নির্যাতিতা নারীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে কৌশল পরিবর্তন করে ওই নারীকে লাখ টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে বরিশাল পুলিশ সুপার ও বরিশালের ডিআইজির কাছে গিয়ে ওসি নির্দোষ কথাটি বলতে হবে। এর আগে নির্যাতিতা নারী বরিশাল পুলিশ সুপারের কাছে ওসির বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করেন। এ দিকে তদন্ত কমিটি আগামী মঙ্গলবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলে কমিটির জনৈক সদস্য জানান। নির্যাতিতা বৃদ্ধা রাশিদা বেগম রোববার বেলা ২টার দিকে মুঠোফোনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি বর্তমানে গড়িয়ার পাড় এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। ওই বাড়ির মালিককে ম্যানেজ করে তার মাধ্যমে ওসি শিশির ও কনস্টেবল জাহিদসহ কতিপয় লোক নিয়ে তাকে (বৃদ্ধা) গড়িয়ার পাড় বাসস্ট্যান্ডের একটি ক্লাবে ডেকে নেয়। এ সময় ওসির সাথে এক কাউন্সিলর, এক সাংবাদিক নেতাসহ চার-পাঁচজন সরকারি দলের নেতাকর্মীকে দেখা গেছে। ওসি আমাকে অভিযোগ প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব প্রত্যাখান না করলে ভয়ভীতি দেখান। আমি আমার অবস্থানে অনড় থাকলে ওসি কৌশল পাল্টিয়ে একপর্যায়ে আমাকে লাখ টাকা দেয়ার প্রলোভন দেখান। বিনিময়ে বরিশাল পুলিশ সুপার ও বরিশালের ডিআইজির কাছে গিয়ে ওসি নির্দোষ কথাটি বলতে হবে। ওসি শিশির তার শেখানো কথা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বলতে বলেন যে, ‘পুলিশ নয় জনগণ মারধর করেছে’। তিনি ওসির বিরুদ্ধে আরো বলেন, ওসি নিজের অপকর্ম ঢাকতে উজিরপুরে তার অনুগত সাংবাদিকদের নিয়ে গোপন বৈঠক করে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার চালিয়েছে। দু’একটি মিডিয়ায় অর্থের বিনিময়ে আমার নামে মিথ্যাচার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওসি মিডিয়ার সাথে মতবিনিময় সভার নামে আমার চরিত্র হনন করেছে। আমি এসবের বিচার চাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উজিরপুরের এক সাংবাদিক জানান, শনিবার ওসি উজিরপুরের কতিপয় মিডিয়াকর্মীদের নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে ওসি তার পক্ষে নিউজ করার জন্য একাধিক সাংবাদিক নেতাকে ম্যানেজ করে ঠিকাদারি দেন। স্থানীয়রা জানান, উজিরপুর ওসি শিশির কুমার পাল উজিরপুরে যোগদানের পরে ক্ষমতাসীনদলের কতিপয় নেতাকর্মীদের হাত করে একের পর এক বাণিজ্য শুরু করে। মাদক নির্মূলে সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলেও ওসি মাসিক মাসোহারা নেয়ায় মাদকের বিস্তার ঘটে। এসব অপকর্ম যাতে প্রকাশ না হয় সেজন্য ওসি শিশির কুমার পাল উজিরপুরে তার একদল অনুগত সাংবাদিক তৈরি করে তাদের মাসিক মাসোহারা দেন। সূত্রে জানা গেছে, ওসি শিশির উজিরপুর মডেল থানায় যোগদানের পর থেকেই উপজেলার আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। যার কারণে আতঙ্কের মধ্যে থাকা উপজেলাবাসী নিজেদের জানমালের নিরাপত্তায় রাত জেগে পাহারাও দিয়েছিল একাধারে কয়েকমাস। কিন্তু তবুও থেমে নেই চুরি-ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। ২০১৮ সালের ১লা মার্চ উজিরপুর মডেল থানায় যোগদানের পরপরই ওসির নির্দেশে মাদক মামলার আসামি ছেড়ে দেয়ার চুক্তিতে ঘুষ নিতে গিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার হন। গত ৮ আগস্ট রাতে ওসির নির্দেশে জামিনে থাকা মামলায় দিনমজুর সোহরাব হোসেন বেপারীর ছেলে হাসান বেপারীকে থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা আটকের পর ছেড়ে দেয়ার শর্তে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় রাতভর হাসানকে থানা হাজতে আটকে রেখে ৯ আগস্ট সকালে আদালতে প্রেরণ করে। পরে কোর্ট জিআরোর কাছে হাসানের জামিনের রি-কলের কাগজপত্র দেখালে হাসানকে ছেড়ে দেয়া হয়।
গত ৩ জুলাই বিকেলে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের উপজেলার মেজর এম এ জলিল সেতু সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ পরিচয়ে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এক সুপার এজেন্টকে অস্ত্র ঠেকিয়ে ১২ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় থানা পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করে আটক করতে পারেনি। সর্বশেষ বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজির কাছে উজিরপুর ওসির বিরুদ্ধে নালিশের অপরাধে গত বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে থানার ভেতরে ও বাইরে রাশেদা বেগম নামে এক বিধবা বৃদ্ধাকে মারধরের অভিযোগে দেশব্যাপী সমালোচিত হয়েছেন ওসি শিশিরসহ এক পুলিশ সদস্য। সমালোচিত এসব কর্মকাণ্ডে জেলা পুলিশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বহু বিতর্কিত ওসি শিশির বহাল থাকায় উজিরপুরবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ভুক্তভোগীরা অনেকেই হয়রানির ভয়ে এই ওসির অপকর্ম নিয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। এ ছাড়া ওসি শিশির যোগদানের পর থেকে বিগত দেড় বছর ধরে উজিরপুর থানায় বেশ কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্ষণ ও প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা। অহরহ হয়রানি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। থানায় বেড়েছে চিহ্নিত দালালদের দৌরাত্ম্য। তা ছাড়া সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায়ও বেশ সমালোচিত ওসি শিশির। স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, উপজেলার আলোচিত জল্লা ইউপির চেয়ারম্যান নান্টু হত্যাকাণ্ডের পর জল্লায় মুসলমানদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ও নারকীয় তাণ্ডবের ঘটনায় ওসির ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছিল। চেয়ারম্যান নান্টু হত্যাকাণ্ডের পরের দিন ওসি শিশিরের উপস্থিতিতে বাহেরঘাট এলাকায় দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে তাণ্ডব চালায়। আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলা হয়েছিল প্রবাসী খোকন সরদারের বহুতলা ভবন ও একই গ্রামের হালিম সিকদারের পুত্র সাইদুল সিকাদার দোকান ঘরটি। দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায় মালামাল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছে, নান্টু হত্যাকাণ্ডের পরপরই ওসির উপস্তিতিতে বেশ কয়েকটি পরিবারের উপর অমানবিক তাণ্ডব চালিয়েছিল কতিপয় সন্ত্রাসীরা। তখন ওসি শিশিরের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি আগুন দেয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দমকল বাহিনীকে ঢুকতে পর্যন্ত বাধা প্রদান করা হয়। এসব অভিযোগের ব্যাপারে উজিরপুর মডেল থানার ওসি শিশির কুমার পালের বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

 


আরো সংবাদ



premium cement