২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লবণের দামে হতাশ চাষিরা

হুমকিতে উপকূলের এই শিল্প; আমদানিতে সতর্কতার দাবি
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সনুয়ার মাঠে উৎপাদিত অপরিশোধিত লবণ ট্রলারে লোড করছে চাষিরা। ছবি দুটি উপজেলার মৌলভী ্বাজার ঘাট থেকে তোলা : এস এম রহমান -

প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে খরচ পড়ে ৩০০ টাকা আর বিক্রি হয় ২০০ টাকা। এভাবে গত দুই মওসুমে লবণ চাষ করে দিশেহারা হয়ে পড়েন উপকূলের হাজার হাজার চাষি। চলতি মওসুমেও উৎপাদিত লবণের দাম নিয়ে হতাশায় পড়েছেন চাষিরা। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে অবাধে লবণ আমদানি বন্ধ করাসহ চাষে প্রণোদনা ও সরকারিভাবে ক্রয়ের দাবি করেছেন চাষিরা। না হয় দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে পড়বে বলে চাষিরা আশঙ্কা করেন।
গত মওসুমে লবণ উৎপাদনের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি চাহিদার বিপরীতে অতিরিক্ত ইন্ডাস্ট্রিজ ও গ্লোবাল সল্ট আমদানি করা হয়। পরবর্তীতে আমদানি করা অতিরিক্ত ইন্ডাস্ট্রিজ ও গ্লোবাল সল্ট বাজারজাত করার কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে রয়েছে। তেমনিভাবে বৈধ ও অবৈধ পথে আমদানি করা এসব লবণে বাজার সয়লাব হওয়ায় মাঠপর্যায়ে হতাশা বাড়ছে।
এ দিকে চলতি বছর ৫৯ হাজার ৫৬৪ একর মাঠে লবণের চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৬ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে এরই মধ্যে গতকাল পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ১৩ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন আগামী মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলে দেশে চাহিদার ১৬ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন বিসিক লবণ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শামিম আলম।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলা নিয়ে দেশের লবণ শিল্প গড়ে উঠেছে। গত বুধবার বাঁশখালী উপকূলের সনুয়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, লবণ মাঠে হাজার হাজার চাষি প্রখর রোদ উপেক্ষা করে লবণ উৎপাদনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। মাঠে লবণ উৎপাদন বেশি হলেও কারো মুখে হাসি নেই। এ সময় সনুয়া ইউনিয়নের খুদুকখালী গ্রামের লবণ চাষি নুরুল আলম, আবদুর রহমান, সামসুল আলম, শাহাব উদ্দিন, জসিম উদ্দিন, ও আমির হোছাইন বলেন, মাঠে এক মণ লবণ উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৩০০ টাকা আর গতকাল পর্যন্ত প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ধোলাই খরচসহ ২৪০ টাকায় অর্থাৎ ২০০ টাকা প্রতি মণ লবণে তাদের ক্ষতি হচ্ছে ১০০ টাকার বেশি। তারা বলেন, একে তো লবণের দাম কম, অন্য দিকে এলাকায় পাইকারি লবণ কেনা হচ্ছে ৪৭ অথবা ৪৮ কেজিতে মণ ধরে। একে তো লবণের দাম কম তার ওপর প্রতি মণে ফড়িয়া বা দালালদের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে।
পাইকারি ব্যবসায়ী ও একই ইউনিয়নের স্থায়ী ব্যবসায়ী নুরুল আবছার বলেন, তিনি একটি লবণ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে গতকাল পর্যন্ত ২৪০ টাকা করে প্রতি মণ লবণ ক্রয় করেছেন তিনি তা ২৬০ টাকা দরে বিক্রি করবেন। প্রতি মণে ৭ থেকে ৮ কেজি লবণ বেশি নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই নিয়ম আগে থেকেই হয়ে আসছে। অন্য দিকে একই সময়ে চট্টগ্রাম মাঝির ঘাটে ও পটিয়া ইন্দ্রোপোল লবণ শিল্পে অপরিশোধিত প্রতি ৭৮ কেজি (দুই মণ) প্রতি বস্তা লবণ ক্রয় করেছেন প্রকারভেদে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা করে। মাঠে উৎপাদিত লবণের বিপণন নিয়ে বছরের পর ধরে চাষিরা প্রতারিত হয়ে আসছেন।
বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি জানিয়েছে, গত বছর গ্লোবাল লবণের (সোডিয়াম সালফেট) চাহিদা ছিল ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন তার বিপরীতে আমদানি করা হয় প্রায় সাড়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন। আর শিল্প লবণের (কসটিক সোডা উৎপাদনের জন্য) চাহিদা ছিল প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ মেট্রিক টন আর আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টনের উপরে।
শিল্প কারখানার ব্যবহারের বিপরীতে আমদানিকৃত লাখ লাখ মেট্রিক টন উদ্বুদ্ধ লবণ অসাধু চক্র প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করায় এক দিকে মাঠপর্যায়ে উৎপাদিত লবণের দরপতন শুরু হয়, যা অব্যাহত রয়েছে।
বিসিক লবণ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, গত মওসুমে (২০১৭-১৮) লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ লাখ মেট্রিক টন এবং চাহিদা ছিল ১৬ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ১ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার উৎপাদন ঘাটতি হয়। এর আগে ২০১৬-১৭ মওসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও ছিল ১৮ লাখ মেট্রিক টন ও চাহিদা ছিল ১৫ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন; ওই মওসুমে চাহিদার চেয়ে ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন ঘাটতি নিয়ে মওসুম শেষ হয়।
ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন ঘাটতির বিপরীতে বিদেশ থেকে ৫ লাখ মেট্রিক টন লবণ আমদানি করে। এ কারণে গত মওসুমে (২০১৭-১৮) চাহিদার বিপরীতে ১ লাখ ২৮ হাজার উৎপাদন ঘাটতি হলেও আমদানিকৃত উদ্বুদ্ধ লবণ থাকায় চলতি বছর বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা না হলেও চাহিদার বিপরীতে অতিরিক্ত ইন্ডাস্ট্রিজ ও গ্লোবাল সল্ট আমদানি করা হয়। তার বেশির ভাগ লবণই বিভিন্ন উপায়ে জনস্বাস্থ্যের তোয়াক্কা না করে প্যাকেট করে বাজারজাত করা হয়। এ কারণে দেশে লবণ চাহিদার ঘাটতির বিপরীতে লবণ আমদানি না করলেও বাজারে অতিরিক্ত লবণ থাকায় মাঠে উৎপাদিত লবণের দরপতন শুরু হয়।
বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বলেন, সরকার যদি বিদেশ থেকে লবণ আমদানির ক্ষেত্রে সতর্ক না হয় তাহলে দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
তিনি বলেন অসাধু ব্যবসায়ীরা শিল্প কারখানার ব্যবহারের বিপরীতে আমদানিকৃত লাখ লাখ মেট্রিক টন উদ্বুদ্ধ লবণ সরাসরি প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির সহযোগী অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান নয়া দিগন্তকে জানিয়েছিলেন, সোডিয়াম সালফেট মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর তাই তিনি এই সোডিয়াম সালফেট আমদানির ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্কতা নেয়ার পরামর্শ দেন।
গতকাল টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, বিসিকের পরিচালক, (উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ) মো: হাবিবুর রহমান বিদেশে অবস্থান করছেন। এ কারণে কোনো মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল