২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হত্যার ৬ দিন আগে থেকেই অভিজিৎকে অনুসরণ করে আসছিল উগ্রবাদীরা

কিলিং মিশনে অংশ নেয় ১১ জন; আসামি করা হয়েছে ফারাবীকেও; চার বছরেও মেলেনি ৫ জনের পরিচয়
-

ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার ছয় দিন আগে থেকেই তাকে অনুসরণ করে আসছিল উগ্রবাদীরা বলে দাবি করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। অভিজিৎকে হত্যার জন্য রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে বাসা ভাড়া করে আস্তানা গেড়েছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা। পরে তথ্য সংগ্রহ ও অভিযান পরিচালনার জন্য দুটি দলে ভাগ হয়ে হত্যা মিশন সম্পন্ন করে। ঘটনার প্রায় চার বছর পর এ মামলার চার্জশিটে উঠে এসেছে এমন তথ্য। ইতোমধ্যে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলার অনুমতির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চার্জশিটটি দাখিল করেছে কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগ।
আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ রায় হত্যার চার বছর পূরণ হবে। তারপরও সরাসরি জড়িত ১১ আসামির মধ্যে পাঁচজনের প্রকৃত নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় তাদের বাদ দিয়ে ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগ। কাউন্টার টেরোরিজম বলছে, চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার পরিকল্পনা ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মোজাম্মেল হোসাইন ওরফে সায়মনের নেতৃত্বে অভিজিতের অবস্থান রেকি করেছে সোহেল ও আকরাম। আর অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছে ২০১৬ সালে গোয়েন্দা পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত মুকুল রানা। এরা সবাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাথে জড়িত। কিন্তু এ সংগঠনের সাথে জড়িত না হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে উসকানি দেয়ার অভিযোগে আসামি করা হয়েছে শফিউর রহমান ফারাবীকে।
গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১১ জনকে চিহ্নিত করেছি। এর বাইরে অভিজিৎকে হত্যায় প্ররোচনা দেয়ার প্রমাণ মিলেছে শফিউর রহমান ফারাবী নামে আরেকজনের বিরুদ্ধে। এই কারণে তাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ১১ জনের মধ্যে আমরা সকলের নাম ঠিকানা পাইনি। ছয়জনের নাম ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধেই আমরা চার্জশিট দিচ্ছি। তিনজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। তারা হলো মোজাম্মেল হোসেন সায়মন, আরাফাত রহমান শামস এবং আবু সিদ্দিক সোহেল। এই তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।
তিনি বলেন, অভিজিৎ হত্যায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চার্জশিটে নাম থাকছে পলাতক মেজর জিয়ার। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিজিৎ হত্যায় প্ররোচনা দেয়ায় চার্জশিটে নাম থাকছে ফারাবীর। গ্রেফতারকৃত তিনজন সায়মন, সোহেল ও আরাফাতের নামও রয়েছে চার্জশিটভুক্ত ছয়জনের মধ্যে। পলাতক হিসেবে আকরাম হোসেন ওরফে আবিরের নাম রয়েছে চার্জশিটে, তার পরিচয় ও ঠিকানা পেয়েছে পুলিশ।
মনিরুল ইসলাম বলেন, অভিজিৎ হত্যার মূল মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত পলাতক মেজর জিয়াউল হক। তার নেতৃত্বে মোট ১১ জন এই কিলিং মিশনে অংশ নেয়। কিলিং স্কোয়াডের প্রধান ছিল মুকুল রানা, সে ডিবির সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। আর ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল সায়মন, সোহেল ও আরাফাত। এই তিনজন গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতার করা যায়নি। তাদের গ্রেফতার করা হলে পরে সম্পূরক চার্জশিট দেয়া হবে। হত্যাকাণ্ডের ছয় দিন আগে থেকে অভিজিৎকে অনুসরণ করে আসছিল।
পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু অভিজিৎ রায় বিদেশে থাকতেন, কবে দেশে আসবেন সেই তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে কিলাররা। অভিজিৎ দেশে ফেরার পর ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে উগ্রবাদীরা তাকে অনুসরণ করতে থাকে। ২২ ফেব্রুয়ারি জাগৃতি প্রকাশনীর সামনে অভিজিৎকে তারা দেখে। সেখান থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের একটি রেস্টুরেন্টে খেতে যান অভিজিৎ। উগ্রবাদীরা ওই পর্যন্ত তাকে ফলো করে কিন্তু সেদিন তারা কিলিং মিশন সফল করতে পারেনি। পরে ২৩ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্তও তারা অভিজিৎকে অনুসরণ করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি তারা হত্যাকাণ্ডটি ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুসারে তারা ঘটনার দিন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। তাদের মূল অপারেশনাল হাউজ ছিল ধানমন্ডিতে। অভিজিৎ হত্যায় রেকির দায়িত্বে ছিল সায়মন ও সোহেল রানা। এ ছাড়া শেষ দিকে হত্যাকারীরা সবাই রেকি করেছিল। ঘটনার সময় ঘটনাস্থলের আশপাশে মেজর জিয়া ও সেলিম নামে আরেকজন সহযোগী ছিল।
সিটিটিসি প্রধান মনির জানান, এ ধরনের মিশনের ক্ষেত্রে আনসার আল ইসলামের সেন্ট্রাল লিডাররা টার্গেটের তালিকা করে হাইকমান্ডে জমা দিত। তারপর হাইকমান্ডের বিচার-বিশ্লেষণ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো হত্যাকাণ্ড কিভাবে ঘটানো হবে। এসব কিলিং মিশনে দুইটি গ্রুপ কাজ করত।
একটি ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ, তারা রেকি করা থেকে শুরু করে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করত। আরেকটি গ্রুপ হচ্ছে কিলার গ্রুপ তারা কিলিং মিশন সফল করত।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বাসায় ফেরার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশের ফুটপাথে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়কে। এ সময় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও আহত হন। ওই ঘটনায় অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বাদি হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর দীর্ঘ তিন বছর মামলাটির তদন্ত করে গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে সিটিটিসি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের মামলাটি প্রথমে পেনাল কোডে রুজু হলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আসামিরা সকলেই আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (আনসার আল ইসলাম) সদস্য হওয়ায় মামলাটির অভিযোগপত্র সন্ত্রাসবিরোধী আইনে প্রস্তুত করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement