২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এ প্লাস সার্টিফিকেট নয় এ প্লাস মানুষ চাই

-

এ প্লাস সার্টিফিকেট নয় বরং এ প্লাস মানুষ চাই। বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে কী হবে যদি মন আর বিবেক অশিক্ষিত থাকে। তাই শুধু জিপিএ ৫ আর সার্টিফিকেট নয় বরং শিক্ষার মধ্য দিয়ে যাতে আদর্শ মানুষ তৈরি করা যায় সে দিকে নজর দেয়া উচিত আমাদের। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আদর্শ মানুষ তৈরির জন্য সে অনুযায়ী পাঠ্যবই যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ আর যোগ্য শিক্ষক। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এ দুটোরই অভাব বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়।
কথাগুলো বললেন প্রবীণ শিক্ষক বিএম আসাদুল্লাহ। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক হিসেবে বিএম আসাদুল্লাহ থানাপর্যায়ে ১১ বার, জেলাপর্যায়ে দুইবার আর বিভাগীয় পর্যায়ে একবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে তিনি রাজধানীর বংশাল নৈশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান।
বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে আলোচিত একটি বিষয় হলো শিক্ষার মান। বিভিন্ন ঘটনায় বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, আলোচনায় উঠে এসেছে শিক্ষাব্যবস্থা আর শিক্ষার মান। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ব্যাপক হারে জিপিএ ৫ পাওয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ব্যাপকসংখ্যক জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ হতে না পারা এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিপর্যয়ের কারণে বারবার সামনে এসেছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় বিএম আসাদুল্লাহর সাথে যিনি দীর্ঘ দিন ধরে শিশুশিক্ষা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে নানা ধরনের উদ্ভাবনী কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে বিএম আসাদুল্লাহ বলেন, লবণ তরকারি দিয়ে প্লেটে করে ভাত মাখিয়ে শিশুর মুখে তুলে দিলে শিশু যেমন শুধুমাত্র চিবিয়ে গেলার কাজ করে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষা হলো অনেকটা সে রকম। তাদের শুধু পড়া গেলানো হচ্ছে। মুখস্থ নয় বরং তাদের আত্মস্থ করানো দরকার। শিশুদের জন্য সরকারি বইয়ের পরিমাণ ঠিক আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলে শিশুদের ওপর ব্যাপক হারে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। শিশুদের ওপর থেকে এ বইয়ের বোঝা সরানোর জন্য সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার। তা নাহলে আর কিছুদিন পর হয়তো শিশুদের ব্যাগ বহনের জন্য কোনো কোম্পানির আবির্ভাব হতে পারে।
বিএম আসাদুল্লাহ বলেন, অনুকরণপ্রিয় শিশুরা বইয়ের থেকে পরিবেশ থেকে বেশি শিক্ষা গ্রহণ করে। সে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পাশাপাশি পরিবারে মা-বাবাকেও শিশুদের সামনে আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করা দরকার। পরিবারে শান্তিশৃঙ্খলা এবং সুন্দর পরিবেশ প্রতিষ্ঠা দরকার তাদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য।
লেখাপড়ার জন্য শিশুদের সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির তীব্র বিরোধিতা করে আসাদুল্লাহ বলেন, পড়ালেখা নিয়ে তাদের মন থেকে ভয় দূর করা উচিত । মনে রাখা দরকার শাস্তি দেয়া হয় অপরাধীদের। শিশুরা ভুল করলে সেটা ভুল, অপরাধ নয়। তাই তাদের শাস্তি দেয়া উচিত নয়।
শিক্ষার মাধ্যমে কিভাবে আদর্শ মানুষ তৈরি সম্ভব সে বিষয়ে তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে মানসম্মত পাঠ্যবই দরকার, যাতে নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব থাকবে। শিক্ষা হওয়া উচিত জীবনঘনিষ্ঠ, নৈতিকতাসম্পন্ন, আনন্দদায়ক, মুখস্থ নয় বরং আত্মস্থ, জীবন থেকে নেয়া, ইংরেজি শিক্ষা এবং অংশগ্রহণমূলক।
এর পাশাপাশি দরকার ভালো মানের শিক্ষক। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষকতার চাকরি শুরু করেন তাদের কাছ থেকে জাতি ভালো কিছু শিখতে পারে না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বস্তরের দুর্নীতি যেমন দূর করা উচিত তেমনি যোগ্য শিক্ষক বাছাই করা দরকার। একই সাথে সৎ মেধাবীরা যাতে শিক্ষকতায় যোগ দেয় সে জন্য সর্বস্তরের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা দরকার।
জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ে বিএম আসাদুল্লাহ বলেন, শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার যোগ্য করে তুলতে হবে। বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধন করতে হবে। শিক্ষা যাতে ব্যক্তি, সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের কাজে লাগে সেটা নিশ্চিত করা দরকার।
সমাজে নানামাত্রিক অনৈতিকতার বিস্তার এবং এর সাথে শিক্ষিত শ্রেণীসহ প্রায় সর্বস্তরের লোকজনের জড়িত হওয়া বিষয়ে বিএম আসাদুল্লাহ বলেন, শিক্ষার লক্ষ্য যদি মনুষ্যত্ব বিকাশ তথা মানুষকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা না হয় তাহলে এর মাধ্যমে বড় বড় ডিগ্রিধারী অনেক ধোঁকাবাজ আর অপরাধী তৈরি হতে পারে। এটা তো স্পষ্ট যে, আমাদের লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য এখন চাকরি করা, জীবিকা অর্জন। ছোটবেলায়ই তো আমাদের শেখানো হতো লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে। দক্ষতা অর্জন অবশ্যই দরকার কিন্তু সেটাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নয়।
সরকারি প্রাইমারি স্কুলের অনেক শিক্ষকের কাছে একজন সুসংগঠক এবং দক্ষ শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত বিএম আসাদুল্লাহ বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন এক সময়। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তার লেখা ‘যোগ্যতাভিত্তিক পরিকল্পিত পাঠদান সহায়িকা’ অনেক শিক্ষকের কাছে একটি পরিচিত বই। সরকারি চাকরি করেও শিক্ষকদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে সম্পৃক্ততা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পষ্টভাষী অবস্থানের কারণে ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন সময় ক্ষতির সম্মুখীনও হয়েছেন প্রবীণ এ শিক্ষক।

 


আরো সংবাদ



premium cement