১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাগ্যহত রোহিঙ্গাদের বিভীষিকার দিনগুলো

জন্মভূমি ছাড়ার বছর পূর্তি
বালুখালী ডি ১৩ ব্লকের আশ্রয়শিবিরে এক বিধবা রোহিঙ্গা নারী : নয়া দিগন্ত - ছবি : নয়া দিগন্ত

গত বছরের আগস্ট মাসে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো জ্বলছিল। উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তবর্তী মানুষেরা এপার থেকে ওপারের আগুনের লেলিহান শিখা দেখেছিল। তাই তো এখানকার কোমল হৃদয়ের মানুষ সর্ব প্রথম রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা দিয়ে তাদের পাশে এগিয়ে আসেন। বর্মিদের আগুন থেকে রা পেতে লাখ লাখ ভাগ্যাহত রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন এক বছর আগে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বর্মি যুবকেরা (মগ) বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পথ আগলে রেখেছিল। তারা পুরুষদের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলেছে। তাদের জেলে পাঠিয়েছে। নারীদের হয় নির্যাতন করেছে, না হয় ফিরিয়ে দিয়েছে। শিশুদের পরিণতি আরো ভয়াবহ। তাদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। আবার অনেক শিশুকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। মিয়ানমারের রাথিডংয়ের উউরুপাড়া সংলগ্ন জঙ্গলে থেকে খেয়ে না-খেয়ে ১০ দিন হেঁটে সেই সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আবদুস সালাম এমনটিই জানিয়েছেন। বর্তমানে তিনি উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছেন।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের কথা জানতে চাইলে কুতুপালং ক্যাম্পের মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, মিয়াসমারের চৌপ্রাং গ্রামের আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদের পুরো পরিবারকে পালিয়ে আসায় পথে হত্যা করা হয়েছে। সৈয়দ আহমদ, তার স্ত্রী আয়েশা খাতুন, দুই ছেলে দিল মোহাম্মদ ও নুরুল ইসলামকে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি একটি এলাকায় হত্যা করা হয়। রাথিডংয়ের চৌপ্রাং এলাকার মৌলভী আমান উল্লাহও একই কথা বলেন। চার রোহিঙ্গা যুবতীকে বিবস্ত্র অবস্থায় হাত ও পা বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পেছনে মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুণ পরই গলায় ছুরি বসিয়ে মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয় ওই চার যুবতীর। সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করা হয়। আরেক দৃশ্যে দেখা যায়, জীবন্ত এক রোহিঙ্গার দেহে ছুরি দিয়ে চামড়া কাটা হচ্ছে। সবশেষ চাইনিজ কুড়াল দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে মাথা কাটা হচ্ছে। অপর এক দৃশ্যে রয়েছে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন রোহিঙ্গা। পেছনে মিয়ানমারের সেনা সদস্য। একজন করে রোহিঙ্গা সামনে রাখা একটি ইটের ওপর ডান হাত রাখছে। আর এক সেনা সদস্য তিন দফায় তার ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত কাটছে। একে একে বেশ কয়েকজনের হাত এভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়। কেউ হাত দিতে না চাইলে তাকে পেছন থেকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হচ্ছে। এমন শত শত দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে আপনারা কি তা দেখেননি? এই প্রতিবেদককে উল্টো প্রশ্ন করেন রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ ইয়াকুব।

কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মিনারা আক্তার বলেন, গত বছর ২৫ আগস্টের পরের রাত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যা করেছে আমার স্বামী নবী হোসেনকে। সেই থেকে পৃথিবী তার কাছে অন্ধকারময়। তিনি কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। স্বামীর লাশ পেছনে ফেলে ৩০ বছর বয়সী মিনারা অজানার পথে পা বাড়িয়েছেন। মিয়ানমারের নৃশংসতার হাত থেকে নিজে বাঁচতে, দুই সন্তানকে বাঁচাতে বাংলাদেশ ছুটে এসেছেন হাজার হাজার মজলুম রোহিঙ্গা কাফেলার সাথে। তখন তিনি ছিলেন নিজে অভুক্ত। অভুক্ত তার দুই মেয়ে। কান্না করেছেন তিনি। আর্তনাদ করেছেন, হাত পেতেছেন। কিন্তু কোনো খাদ্য পাননি। সেই সময়ে ত্রাণ নিতে যে যুদ্ধ করতে হয়েছে তাতে তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। ুধার্ত দুই মেয়েকে নিয়ে রাস্তার ধারে বসে পড়ি। এমন সময় এখানকার স্থানীয় বাংলাদেশী এক যুবক তার বাসার রান্না করা খাবার ও পানি দিয়েছিল। পিপাসায় কাতর ুধার্ত আমার মতো অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে সেদিন ওই সব যুবক আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের জন্মভূমিতে আমরা স্থান পায়নি। সেখানে আমাদের চরম বিপদের সময়ে আপনাদের মতো মানুষেরা সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন এবং আমাদেরকে থাকতে সুযোগ দিয়েছেন।

তখন আমাদের খাবার ছিল না। থাকার জায়গা ছিল না। এখানে এসেও আমাকে খোলা আকাশের নিচে অনেক দিন থাকতে হয়েছে। এখন ক্যাম্পে আমাদের ঠিকানা হয়েছে। খাদ্য, সেবা ও বাসস্থানের কিছুটা নিশ্চয়তা পেয়েছি আমরা। কিন্তু আমাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরা যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি।


আরো সংবাদ



premium cement