২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সোনাগাজীতে ডাকাতির মহোৎসব কোটি টাকার সম্পদ লুট

-

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে চলছে ডাকাতির মহোৎসব। গত দেড় মাসে উপকূলীয় এ এলাকায় অন্তত ১৫টি ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতিকালে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি থেকে লুট হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকার মালামাল। এসব ঘটনায় পুলিশের সাথেও ডাকাতদের গুলিবিনিময় হয়েছে। পুলিশ সদস্য ছাড়াও ডাকাত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরাও আহত হয়েছেন। একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় উপজেলার সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পুলিশ, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের চর এলাহি গ্রামে গত বৃহস্পতিবার রাতে দুই বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতদল দু’টি বাড়ি থেকে ৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ ৯ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
একই রাতে উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ভূঞা বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ডাকাতদের গোলাগুলি হয়। গোলাগুলিতে পুলিশের এক এসআইসহ ছয়জন আহত হয়েছেন। এ সময় আহতাবস্থায় অস্ত্রসহ আজিজুল হক (৪৭) ও মো: ইসরাফিল (৪৯) নামে দুই ডাকাতকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি দেশীয় একনলা বন্দুক ও দুই রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে। উভয়ে সোনাগাজী উপজেলার বাসিন্দা। তাদের বিরুদ্ধে সোনাগাজী মডেল থানায় হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও ডাকাতির অভিযোগে আটটি করে মামলা রয়েছে। ওই ঘটনায় পুলিশের এসআই মো: মঈনাল হোসেন, সহকারী এএসআই আরিফুর রহমান, পুলিশ কনস্টেবল আবুল খায়ের, বাবুল সরকার, মফিজ উদ্দিন ও আবদুল লতিফ আহত হন। শুক্রবার রাতে উপজেলার চর এলাহি গ্রামের বদি উল আলম মাস্টার বাড়িতে ৯-১০ জনের মুখোশধারী সশস্ত্র ডাকাত হানা দেয়। ডাকাতেরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে অস্ত্রের মুখে পরিবারের সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। গৃহকর্তা নাজিম উদ্দিন বলেন, রাত আড়াইটার দিকে ডাকাতেরা তাদের ঘরে ঢুুকে তিনটি আলমিরার তালা ভেঙে সাড়ে তিন ভরি স্বর্ণালঙ্কার, এক লাখ টাকা, একটি ফোন, কাপড় চোপড়সহ চার লাখ টাকার মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নিয়ে গেছে। এ সময় বাধা দিলে ডাকাতেরা নাজিম উদ্দিনকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও তার স্ত্রীকে পিটিয়ে আহত করে। পরিবারের লোকজনের শোরচিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসার আগেই ডাকাতেরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
এ দিকে একই রাত সাড়ে ৩টার দিকে পাশের রসুল আহম্মদের বাড়িতে ১০-১২ জনের একটি মুখোশধারী সশস্ত্র ডাকাতদল ঘরে ঢুকে পরিবারের সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-পা বেঁধে তিনটি আলমিরার তালা ভেঙে সাড়ে ৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, ২০ হাজার টাকা, দু’টি মোবাইল ফোনসহ পাঁচ লাখ টাকার জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে। সেখানেও ডাকাতেরা স্বামী-স্ত্রীকে কুপিয়ে আহত করে।
জানা যায়, ১৩ জুলাই রাতে উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের চর কৃষ্ণজয় গ্রামে সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট ইকবাল হোসেনের বাড়িসহ একই ইউনিয়নের চর লামছি গ্রামের দুই বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ওই রাতে ডাকাতদল দুই বাড়ি থেকে ২৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ ১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে বলে জানা গেছে। ডাকাতেরা সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট ইকবাল হোসেনের ঘরে ঢুকে চারটি আলমিরার তালা ভেঙে ১১ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, ৮০ হাজার টাকা, দু’টি ফোন, কাপড় চোপড়সহ আট লাখ টাকার মালামাল লুট করে। এ দিকে একই রাতে পাশের চর লামছি গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের বাড়িতে ১৪-১৫ জনের একটি মুখোশধারী সশস্ত্র ডাকাতদল পরিবারের সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-পা বেঁধে তিনটি আলমিরার তালা ভেঙে ১২ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, ১৫ হাজার টাকা, ২টি মোবাইল ফোনসহ ৭ লাখ টাকার জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে।
৩ জুলাই ডাকাতির প্রস্তুতিকালে বেলাল হোসেন (৩৮) ও মকসুদ আলমকে (৩৭) অস্ত্রগুলিসহ গ্রেফতার করে সোনাগাজী পুলিশ। ওই দিন ডাকাতেরা মঙ্গলকান্দি ২০ শয্যা হাসপাতালের সামনে অবস্থান করে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় উপজেলার সদর ইউনিয়নের শাহাপুর এলাকা থেকে টহল পুলিশ মকসুদ আলম নামে অপর ডাকাতকে গ্রেফতার করে। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় বেলালকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। বেলালের বিরুদ্ধে ডাকাতি, হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও অস্ত্র আইনে থানায় আটটি এবং মকসুদের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগে ৪টি মামলা রয়েছে। ৯ জুলাই সোনাগাজী উপজেলার চর গণেশ এলাকা থেকে আন্তঃজেলা ডাকাতদলের সদস্য ওমর ফারুককে (২৬) গ্রেফতার করে পুলিশ। ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে থানায় ডাকাতি ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে দু’টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া স্কুল থেকে শিশুসন্তান আনতে গেলে পৌর এলাকার বকুল ভবনের ভাড়াটিয়া ফারহানা আক্তারের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি হয়। চোরেরা তার বাসা থেকে টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারসহ লক্ষাধিক টাকার মালামাল চুরি করে।
একই মাসে উপজেলার চর মজলিশপুর ইউনিয়নের চরলক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ডাকাতদের গোলাগুলি হয়। গোলাগুলিতে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন আহত হয়েছেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ এনামুল হক (২৫) নামে এক ডাকাতকে গ্রেফতার করা হয়।
ওই রাতে উপজেলার চর মজলিশপুর ইউনিয়নের চর লক্ষ্মীগঞ্জের চৌরাস্তা এলাকায় ১৫-১৬ জনের একদল সশস্ত্র ডাকাত অবস্থান নিয়ে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতেরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে ২০ রাউন্ড পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এনামুল হক নামে একজনকে গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে একটি একনলা বন্দুক, দুই রাউন্ড গুলি ও কয়েকটি ছোরা উদ্ধার করেছে। এনামুলের বিরুদ্ধে সোনাগাজী ও নোয়াখালীর সেনবাগসহ কয়েকটি থানায় বিভিন্ন হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও ডাকাতির অভিযোগে ৭-৮টি মামলা রয়েছে।
এ দিকে জুলাই মাসে সফরপুর থেকে আন্তঃজেলা ডাকাতদলের সদস্য আবদুল হাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার দেহ তল্লাশি করে একটি মোবাইল ফোন ও ১০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ফেনী সদর ও সোনাগাজী মডেল থানায় ডাকাতি, দস্যুতা ও চাঁদাবজির অভিযোগে ছয়টি মামলা রয়েছে।
২৫ জুন উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের দশপাইয়া গ্রামের ইরাক প্রবাসী শহিদুল ইসলাম ও বক্তারমুন্সি শেখ শহিদুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের এমএলএসএস আবদুল হকের বাড়ি থেকে ডাকাতেরা পাঁচ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। এ সময় ডাকাতদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আবদুল হক গুরুতর আহত হন।
এর আগে গত মে ও জুন মাসে উপজেলার মতিগঞ্জ, বগাদানা, মঙ্গলকান্দি ও আমিরাবাদ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে প্রবাসীর বাড়িসহ ১৩ বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতদল ওই সব বাড়ি থেকে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্রসহ প্রায় এক কোটি টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
জানতে চাইলে সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মো: মোয়াজ্জেম বলেন, কয়েকটি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর পরিদর্শন করেছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধারসহ ডাকাতদের গ্রেফতারে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে।
জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান জেড এম কামরুল আনাম বলেছেন, স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্তের সহযোগিতায় বহিরাগত পেশাদার ডাকাতেরা একের পর এক ডাকাতির ঘটনা ঘটাচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে স্থানীয়দেরকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement